প্রাকৃতিক ভূগোলের বিষয়বস্তু: অশ্মমণ্ডল, বারিমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল ও জীবমণ্ডল

ভূগোল কেবল মানচিত্র বা স্থানের বর্ণনা নয়— এটি আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে বোঝার বিজ্ঞান। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো প্রাকৃতিক ভূগোল। সময়ের সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আধুনিক চিন্তাধারার কারণে প্রাকৃতিক ভূগোলের সংজ্ঞা যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, তেমনি এর পরিধিও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে।

পৃথিবীর জন্ম ও বিবর্তন, ভূপ্রকৃতি, শিলা ও খনিজ, ভূমিরূপ, নদ-নদী, জলবায়ু, মৃত্তিকা, ইত্যাদি প্রাকৃতিক ভূগোলের মূল বিষয়বস্তু। সহজভাবে বলা যায়— পৃথিবীর প্রকৃতিগত রূপ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রাকৃতিক ভূগোল আলোচনা করে।

🔎 প্রাকৃতিক ভূগোলের চারটি প্রধান মণ্ডল

প্রাকৃতিক ভূগোল মূলত চারটি মণ্ডলকে ঘিরে আবর্তিত:

  1. অশ্মমণ্ডল (lithosphere);
  2. বারিমণ্ডল (hydrosphere);
  3. বায়ুমণ্ডল (atmosphere); এবং
  4. জীবমণ্ডল (biosphere)।

এ চারটি মণ্ডল পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত এবং একে অপরের উপর নির্ভরশীল। নিচে প্রতিটি মণ্ডলকে সহজভাবে আলোচনা করা হলো।

🪨 অশ্মমণ্ডল (lithosphere)

পৃথিবীর কঠিন স্তর বা ভূত্বককে বলা হয় অশ্মমণ্ডল। এ ভূত্বকের উপরিভাগে জীবজগৎ বিকশিত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ শক্তির প্রভাবে এখানে গড়ে উঠেছে বিচিত্র ভূমিরূপ। যেমন- পর্বত, মালভূমি ও সমভূমি।

অশ্মমণ্ডল কেবল ভূমিরূপ সৃষ্টি করে না, বরং প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য অপরিহার্য উপাদান সরবরাহ করে। মৃত্তিকা ও খনিজের মাধ্যমে এটি জীবের জীবনধারণে সহায়তা করে। বলা যায়, অশ্মমণ্ডলই হলো পৃথিবীর জীবনের অন্যতম ভিত্তি।

💧 বারিমণ্ডল (hydrosphere)

পৃথিবীর ৭১% অংশ জুড়ে রয়েছে পানি। মহাসাগর, সাগর, নদ-নদী, উপসাগর, হ্রদ ও বিভিন্ন জলাশয় মিলেই তৈরি হয়েছে বারিমণ্ডল। এর আয়তন প্রায় ৩৬ কোটি ২৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার।

বারিমণ্ডল পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সূর্যের তাপে পানি বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমণ্ডলে ওঠে, মেঘ তৈরি করে, আর পরে বৃষ্টি বা তুষার আকারে আবার ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। এভাবেই পানি পৃথিবীর প্রাকৃতিক চক্র বজায় রাখে।

🌤️ বায়ুমণ্ডল (atmosphere)

পৃথিবীকে ঘিরে থাকা হাজার কিলোমিটার পুরু গ্যাসীয় স্তরই হলো বায়ুমণ্ডল। এটি ভূত্বকের কয়েক মিটার উপরে শুরু হয়ে প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।

বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে, সূর্যের শক্তি ধারণ করে এবং জীবজগতের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন, নাইট্রোজেনসহ নানা গ্যাস সরবরাহ করে। উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে এর ঘনত্ব কমে যায়। জীবজগতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বায়ুমণ্ডলের ভূমিকা অপরিসীম।

🐾 জীবমণ্ডল (biosphere)

অশ্মমণ্ডল, বারিমণ্ডল ও বায়ুমণ্ডলের সমন্বয়ে গঠিত হলো জীবমণ্ডল। এখানেই প্রাণের অস্তিত্ব বিদ্যমান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উঁচু পর্যন্ত এবং ৭ কিলোমিটার গভীরে পর্যন্ত জীব পাওয়া যায়।

অর্থাৎ প্রায় ১৩ কিলোমিটার পুরু এক জীবন্ত স্তরই হলো জীবমণ্ডল। পরিবেশবিদরা জীবমণ্ডলকে আরও ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করেছেন, যেগুলোকে বলা হয় বাস্তুতন্ত্র (ecosystem)। প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রই একেকটি ক্ষুদ্র জগৎ, যেখানে উদ্ভিদ, প্রাণী ও পরিবেশ পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত।

প্রাকৃতিক ভূগোল, ভূগোলের বিষয়বস্তু, অশ্মমণ্ডল, বারিমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল, জীবমণ্ডল, প্রাকৃতিক ভূগোলের মণ্ডলসমূহ, Physical Geography in Bangla, পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভূগোল, ভূগোল নোট
প্রাকৃতিক ভূগোলের চারটি মণ্ডল ও এদের মধ্যকার সম্পর্ক। ছবি: worldatlas.com

🔄 মণ্ডলসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক

চারটি মণ্ডল আলাদা হলেও আসলে একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।

🌊 বারিমণ্ডল থেকে জীবরা পায় পানি;

🪨 অশ্মমণ্ডল থেকে পায় খনিজ পদার্থ; এবং

🌬️ বায়ুমণ্ডল থেকে পায় অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয় গ্যাস।

এসবের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে জীবমণ্ডল, যা জীবজগতকে টিকিয়ে রেখেছে।

প্রাকৃতিক ভূগোল আমাদের শেখায় পৃথিবী কীভাবে গঠিত হয়েছে এবং প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান কীভাবে জীবনের সাথে যুক্ত। অশ্মমণ্ডল, বারিমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল ও জীবমণ্ডল— এ চারটি মণ্ডলই আসলে একসাথে পৃথিবীর জীবনকে টিকিয়ে রাখছে। আমরা যদি প্রকৃতিকে বুঝি ও সম্মান করি, তাহলেই পৃথিবীর এ চমৎকার ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব।


✍️ লেখক: মো. শাহীন আলম


🔗 সহায়িকা:
১। Singh, Savindra, (2009), Physical Geography, Prayag Pustak Bhawan, Allahbad, India;
২। রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, (২০১৭ – ২০১৮), কবির পাবলিকেশনস, ঢাকা;
৩। রউফ, কাজী আবদুর, (২০০২), প্রাকৃতিক পরিবেশ, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা;
৪। রউফ, কাজী আবদুর, (২০১১), প্রাকৃতিক ভূগোল পরিচিতি, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা।


Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL


দ্রাঘিমারেখার ব্যবহার: যে কোনো স্থান-দেশের সময়ের পার্থক্য নির্ণয়


Leave a Reply