প্রাকৃতিক ভূগোলের সাথে অন্যান্য বিজ্ঞানের সম্পর্ক

ভূগোল কেবল নিজের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের নানা শাখার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বিশেষ করে প্রাকৃতিক ভূগোল পৃথিবীর ভৌত বৈশিষ্ট্য, প্রক্রিয়া ও প্রতিফলন (phenomena) বোঝার জন্য অন্যান্য বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। নিচে তার কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো—

১। প্রাকৃতিক ভূগোল ও পদার্থবিজ্ঞান

পদার্থবিজ্ঞান প্রাকৃতিক বিশ্বের গঠন ও মৌলিক নিয়ম ব্যাখ্যা করে, আর প্রাকৃতিক ভূগোল পৃথিবীর ভৌত বৈশিষ্ট্য ও প্রক্রিয়ার বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করে। যেমন—

  • মাধ্যাকর্ষণ বল: জোয়ারভাটা, ভূমিধস, হিমবাহের গতি, পানির প্রবাহ, প্রভৃতি নিউটনের সূত্রে ব্যাখ্যা করা যায়।
  • গতি ও বল: বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রস্রোত, বৃষ্টিপাতের মতো প্রপঞ্চ পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র ছাড়া বোঝা যায় না।
  • তাপ ও গ্যাস: পদার্থবিজ্ঞান বায়ুমণ্ডলের প্রক্রিয়াসমূহের ব্যাখ্যায় অপরিহার্য।

২। প্রাকৃতিক ভূগোল ও রসায়ন

ভূগোলের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হলো শিলা, খনিজ, বায়ু, পানি ও মৃত্তিকার গঠন। এসব বুঝতে রসায়নের অবদান অপরিসীম। যেমন—

  • মৃত্তিকা ক্ষয়, কার্স্ট ভূমিরূপ, পরিবেশ দূষণ, ইত্যাদি রসায়ন ছাড়া ব্যাখ্যা করা যায় না।

৩। প্রাকৃতিক ভূগোল ও উদ্ভিদবিদ্যা

উদ্ভিদ জীবমণ্ডলের অপরিহার্য অংশ। ভূপৃষ্ঠে উদ্ভিদের উৎপত্তি, বণ্টন ও শ্রেণিবিন্যাস ভূগোলের আলোচ্য বিষয়।

  • জলবায়ু উদ্ভিদের উৎপত্তি ও বিস্তৃতিকে প্রভাবিত করে। 
  • সালোকসংশ্লেষণ, প্রস্বেদন, অভিস্রবণ, প্রভৃতি প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা উদ্ভিদবিদ্যার মাধ্যমে সম্ভব।

৪। প্রাকৃতিক ভূগোল ও প্রাণিবিজ্ঞান

প্রাণিজগৎ জীবমণ্ডলের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রাণীর উৎপত্তি, বণ্টন, বিস্তরণ, ইত্যাদি ভূগোলে আলোচিত হয়। এসব ব্যাখ্যা প্রাণিবিজ্ঞান ছাড়া অসম্পূর্ণ।

৫। প্রাকৃতিক ভূগোল ও ভূতত্ত্ব

ভূতত্ত্ব পৃথিবীর উৎপত্তি, বিবর্তন, শিলা-খনিজ, ভাঁজ, চ্যুতি, ক্ষয়-সঞ্চয়, প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করে। এ বিষয়গুলো ভূরূপবিজ্ঞান তথা প্রাকৃতিক ভূগোলের মূল উপাদান।

৬। প্রাকৃতিক ভূগোল ও মৃত্তিকাবিজ্ঞান

মৃত্তিকা জীবমণ্ডলের ভিত্তি। উদ্ভিদের জন্ম ও বিকাশ মূলত মৃত্তিকার গুণাবলির ওপর নির্ভরশীল। মৃত্তিকার গঠন, উপাদান, বুনন, রঙ ও বিস্তরণ ভূগোলের আলোচ্য বিষয়।

৭। প্রাকৃতিক ভূগোল ও জ্যোতির্বিদ্যা

পৃথিবী সৌরজগতের একটি গ্রহ হওয়ায় ভূগোল জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। যেমন—

  • সূর্যের দূরত্ব ও কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা ঋতুচক্রকে প্রভাবিত করে।
  • সূর্য-চন্দ্রগ্রহণ, মহাজাগতিক বস্তু ও পৃথিবীর অক্ষ হেলনের প্রভাব ব্যাখ্যায় জ্যোতির্বিজ্ঞান অপরিহার্য।

৮। প্রাকৃতিক ভূগোল ও সমুদ্রবিজ্ঞান

সমুদ্রবিজ্ঞান আলোচনায় মহাসাগরীয় স্রোত, লবণাক্ততা, তাপমাত্রা, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ও তলানির মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত। জোয়ারভাটা বা সাগরের আকার-আয়তন সম্পর্কেও ভূগোল ও সমুদ্রবিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে।

৯। প্রাকৃতিক ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান

পরিবেশবিজ্ঞান আলোচনায় বায়ু, পানি, আলো, তাপ, মৃত্তিকা, উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ অন্তর্ভুক্ত। এগুলো জীবনের উৎপত্তি, স্থায়িত্ব ও বিকাশকে প্রভাবিত করে। প্রাকৃতিক ভূগোল এসব উপাদানের অবস্থান, বিস্তৃতি ও আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে।

পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাকৃতিক ভূগোল একটি সমন্বিত বিদ্যা, যা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখার সাথে আন্তঃসম্পর্ক স্থাপন করেছে। পদার্থবিজ্ঞান থেকে শুরু করে রসায়ন, জীববিদ্যা, ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্বিজ্ঞান কিংবা পরিবেশবিজ্ঞান— প্রত্যেকটি শাখা ভূগোলকে সমৃদ্ধ করে। আবার, ভূগোলও এসব বিজ্ঞানের প্রয়োগ ও বাস্তব প্রমাণ সরবরাহ করে। তাই প্রাকৃতিক ভূগোলকে কেবল একটি পৃথক বিদ্যা নয়, বরং একটি সমন্বিত বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্র হিসেবে দেখা উচিত।


✍️ লেখক: মো. শাহীন আলম


🔗 সহায়িকা:
১। Singh, Savindra, (2009), Physical Geography, Prayag Pustak Bhawan, Allahbad, India;
২। রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, (২০১৭ – ২০১৮), কবির পাবলিকেশনস, ঢাকা;
৩। রউফ, কাজী আবদুর, (২০০২), প্রাকৃতিক পরিবেশ, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা;
৪। রউফ, কাজী আবদুর, (২০১১), প্রাকৃতিক ভূগোল পরিচিতি, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা;
৫। Chorley, R. J., & Haggett, P. (1971). Models in Geography. London: Methuen;
৬। Strahler, A. N. (1992). Physical Geography: Science and Systems of the Human Environment. New York: Wiley;
৭। Miller, G. T., & Spoolman, S. (2012). Environmental Science. Belmont: Cengage Learning;
৮। বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটি। (২০০৬)। ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা. ঢাকা: বিওইউ প্রকাশনা।


Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL


কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি

দ্রাঘিমারেখার ব্যবহার: যে কোনো স্থান-দেশের সময়ের পার্থক্য নির্ণয়

ওয়েগনারের মহাদেশ সঞ্চালন তত্ত্ব


 

Leave a Reply