প্রাকৃতিক ভূগোল: সংজ্ঞা, প্রকৃতি, পরিসর ও প্রধান শাখা

প্রাকৃতিক ভূগোল হলো ভূ-বিজ্ঞানের সেই শাখা, যেখানে পৃথিবীর ভূত্বকের ভৌত পরিবেশ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ভূ-প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিভিন্ন ভূগোলবিদের সংজ্ঞায় প্রাকৃতিক ভূগোল:

  • কার্ল রিটার (১৭৭৯–১৮৫৯) বলেছেন—
    “প্রাকৃতিক ভূগোল হলো বিজ্ঞানের সেই শাখা, যা পৃথিবীর সব অবয়ব, বৈচিত্র্য ও পারস্পরিক সম্পর্ককে একটি স্বতন্ত্র একক হিসেবে বিবেচনা করে।”
  • রিচার্ড হার্টশোর্ন (১৮৯৯–১৯৯২)-এর মতে—
    “ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যের সঠিক, সুবিন্যস্ত ও যৌক্তিক বর্ণনা ও ব্যাখ্যা প্রদানই প্রাকৃতিক ভূগোলের উদ্দেশ্য।”
  • আর্থার হোমস (১৯৬০) বলেছেন—
    “পৃথিবী পৃষ্ঠের বন্ধুরতা, সাগর-মহাসাগর ও বায়ুমণ্ডল—যা মিলে প্রাকৃতিক পরিবেশ গঠিত হয়—সেগুলোর সমীক্ষাই প্রাকৃতিক ভূগোলের কাজ।”

প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতি ও পরিসর

প্রাকৃতিক ভূগোল হলো প্রাকৃতিক প্রপঞ্চসমূহের স্থানিক (spatial) ও কালিক (temporal) বিশ্লেষণ। আঞ্চলিক স্কেলে এটি বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং ভিন্নতা নিয়ে আলোচনা করে। এখানে মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্কও অন্তর্ভুক্ত, ফলে এটি ভূগোলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপক্ষেত্র।

প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতি

  • বিষয়বস্তু: পৃথিবী (জীবন, সম্পদ, বাস্তুতন্ত্রের উৎস);

    • উপাদান:

      1. বায়ুমণ্ডল (Atmosphere)

      2. বারিমণ্ডল/জলমণ্ডল (Hydrosphere)

      3. অশ্মমণ্ডল/স্থলভাগ (Lithosphere)

      4. জীবমণ্ডল (Biosphere)

  • মহাবিশ্ব ও সৌরজগতের উৎপত্তি ও বিকাশ;

  • পৃথিবীর আকার, আয়তন, কক্ষপথ, গতি, উপগ্রহ, অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ;

  • সৌরশক্তি, শক্তির বিন্যাস, বাস্তুতান্ত্রিক চক্র;

  • পানি, বায়ুমণ্ডল, উদ্ভিদ, প্রাণী সম্পর্কিত গবেষণা;

  • সর্বজনীন প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা ব্যাখ্যা; এবং

  • ভূমিরূপ, ভূ-গাঠনিক প্রক্রিয়া, পাত/প্লেট সঞ্চালন তত্ত্ব, ইত্যাদি অধ্যয়ন।

প্রাকৃতিক ভূগোলের পরিসর

প্রাকৃতিক ভূগোল আবহাওয়া, জলবায়ু, মৃত্তিকা, উদ্ভিদ, প্রাণী, পানি (বিভিন্ন রূপে) এবং ভূমিরূপের স্থানিক ধরন বিশ্লেষণ করে। এছাড়া এ উপাদানগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক এবং মানবক্রিয়ার প্রভাবও পর্যালোচনা করে। সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের কর্মকাণ্ডজনিত পরিবেশ অবক্ষয় বৃদ্ধির ফলে এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। এখন প্রাকৃতিক ভূগোল শুধু স্থানিক বিশ্লেষণেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষ-প্রকৃতি সম্পর্কের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণও অন্তর্ভুক্ত করছে।

প্রধান ক্ষেত্রসমূহ:

  1. ভূমিরূপবিদ্যা (geomorphology):
    পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা, উৎপত্তি, ভূতাত্ত্বিক সময়সূচি, ভূ-আন্দোলন, অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্প ও বিভিন্ন ভূমিরূপ নিয়ে গবেষণা করে।

  2. জলবায়ুবিদ্যা (climatology):
    বায়ুমণ্ডলের উপাদান, তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, বায়ুপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, জলীয়বাষ্প, বৃষ্টিপাত, জলবায়ু অঞ্চল ও পূর্বাভাস পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে।

  3. সমুদ্র ভূগোল (marine geography):
    সাগর ও মহাসাগরের উৎপত্তি, বিন্যাস, সমুদ্রস্রোত, তরঙ্গ, জোয়ার-ভাটা, সমুদ্রতলের ভূপ্রকৃতি এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে।

  4. মৃত্তিকা ভূগোল (soil geography):
    মৃত্তিকার উৎপত্তি, গঠন, বিস্তরণ, প্রকারভেদ এবং মৃত্তিকা-পরিবেশ সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করে।

  5. জীবভূগোল (biogeography):
    উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের বিস্তরণ, পরিবেশের সাথে তাদের অভিযোজন এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করে।

একনজরে প্রাকৃতিক ভূগোলের সংজ্ঞা, প্রকৃতি, পরিসর ও শাখাগুলো নিম্নের সারণিতে তুলে ধরা হলো:

বিষয় মূল পয়েন্ট
সংজ্ঞা

পৃথিবীর ভৌত পরিবেশ ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া নিয়ে অধ্যয়নই হলো প্রাকৃতিক ভূগোল।

কার্ল রিটার: পৃথিবীকে বৈচিত্র্যসহ স্বতন্ত্র একক হিসেবে দেখা।

হার্টশোর্ন: ভূপৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্যের সুবিন্যস্ত বর্ণনা।

হোমস: ভূপৃষ্ঠ, সাগর-মহাসাগর ও বায়ুমণ্ডলের সমীক্ষা।

প্রকৃতি (Nature)

1. বিষয়বস্তু: পৃথিবী (জীবন, সম্পদ, বাস্তুতন্ত্রের উৎস)

2. উপাদান: বায়ুমণ্ডল, বারিমণ্ডল, অশ্মমণ্ডল, জীবমণ্ডল

3. মহাবিশ্ব ও সৌরজগতের উৎপত্তি ও বিকাশ

4. পৃথিবীর আকার, আয়তন, কক্ষপথ, গতি, উপগ্রহ, অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ

5. সৌরশক্তি, বাস্তুতান্ত্রিক চক্র

6. পানি, বায়ু, উদ্ভিদ, প্রাণী বিষয়ক গবেষণা

7. ভূমিরূপ, ভূগাঠনিক প্রক্রিয়া, পাত সঞ্চালন তত্ত্ব

পরিসর (Scope) প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর স্থানিক ধরন, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং মানব প্রভাবের বিশ্লেষণ। সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ অবক্ষয় বৃদ্ধির কারণে এর গুরুত্ব বেড়েছে।
প্রধান শাখা

1. ভূমিরূপবিদ্যা: পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিরূপ সৃষ্টি।

2. জলবায়ুবিদ্যা: বায়ুর উপাদান, তাপমাত্রা, চাপ, প্রবাহ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস।

3. সমুদ্র ভূগোল: সাগর-মহাসাগরের উৎপত্তি, স্রোত, তরঙ্গ, জোয়ার-ভাটা, সমুদ্রতল।

4. মৃত্তিকা ভূগোল: মৃত্তিকার উৎপত্তি, গঠন, বিস্তরণ, পরিবেশ সম্পর্ক।

5. জীবভূগোল: উদ্ভিদ-প্রাণীর বিস্তরণ, অভিযোজন, পরিবেশ ভারসাম্য।

প্রাকৃতিক ভূগোল মানুষের কর্মকাণ্ড ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ অবক্ষয়ের কারণে এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে।


✍️ লেখক: মো. শাহীন আলম


🔗 সহায়িকা:
১। Singh, Savindra, (2009), Physical Geography, Prayag Pustak Bhawan, Allahbad, India;
২। রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, (২০১৭ – ২০১৮), কবির পাবলিকেশনস, ঢাকা;
৩। রউফ, কাজী আবদুর, (২০০২), প্রাকৃতিক পরিবেশ, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা;
৪। রউফ, কাজী আবদুর, (২০১১), প্রাকৃতিক ভূগোল পরিচিতি, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা।


Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL


ওয়েগনারের মহাদেশ সঞ্চালন তত্ত্ব

কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি

দ্রাঘিমারেখার ব্যবহার: যে কোনো স্থান-দেশের সময়ের পার্থক্য নির্ণয়


Leave a Reply