ঐতিহাসিক শিখরী স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন: ফেনীর সাত মন্দির
ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন, সাত মন্দির, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা শহরের পশ্চিমে বাঁশপাড়ায় অবস্থিত। প্রাচীন এই মন্দিরগুলো স্থানীয়ভাবে সাত মঠ নামে সুপরিচিত। অনেকেই এই মন্দিরগুলোকে সাত মন্দির বাড়ি নামেও চিনে থাকেন।
সাত মন্দির হলো পাশাপাশি অবস্থিত উঁচু শিখরবিশিষ্ট সাতটি মন্দির। তবে, এখানে সাতটি মন্দিরের সাথে আরও দু’টি ছোট আকারের মন্দির রয়েছে। ছোট-বড় মিলিয়ে এখানে সর্বমোট মন্দিরের সংখ্যা ৯টি। এখানকার মন্দিরগুলো মূলত চিতা মন্দির বা স্মৃতি মন্দির। পাশাপাশি এক সারিতে তিনটি এবং অপর সারিতে চারটি মন্দির এক সমকোণে অবস্থান করছে। দক্ষিণ সারির চারটি মন্দির বর্গাকার এবং পূর্ব সারির তিনটি মন্দির অষ্টভূজাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হয়েছে।
একতলা (প্রায় ১০ থেকে ১৫ ফুট) সমপরিমাণ উচ্চতা থেকে মন্দিরগুলো ক্রমে সরু হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দির শিখরের শেষ প্রান্তে কলস নকশা শোভিত রয়েছে। বর্গাকার ভূমি পরিকল্পনার মন্দিরগুলোর মাঝখানের শিখরের চারকোণে একটি করে মোট চারটি ছোট শিখর রয়েছে। যা এ মন্দির চারটিকে পঞ্চরত্ন মন্দিরের রূপ দিয়েছে। প্রতিটি মন্দিরের গায়ে দৃষ্টিনন্দন অলংকরণ রয়েছে। শিখরী স্থাপত্য শিল্প রীতির প্রাচীন এ নিদর্শন নির্মাণে চুন, সুরকি এবং পোড়ামাটির ইট ব্যবহার করা হয়েছে।
ফেনী জেলার শিখরী স্থাপত্য শিল্প রীতির সাত মন্দিরের সাথে বরিশাল জেলার মাহিলাড়া মঠ, চাঁদপুর জেলার যাত্রা মুনির মঠ ও সত্যরাম মজুমদারের মঠ, এবং কুমিল্লা জেলার বেওলাইন মঠ ও ধনঞ্জয় মঠের স্থাপত্যিক কাঠামোর বেশ মিল খুঁজে পাওয়া য়ায়। তবে, একই স্থানে পাশাপাশি অবস্থিত এক সাথে নয়টি মন্দির নিয়ে এ ধরনের গুচ্ছ মন্দির বা মঠ বাংলাদেশের অন্যত্র আছে কিনা, তা এখনও পর্যন্ত জানা যায় না।
বিশ্বায়নের এই যুগে আধুনিক উন্নয়ন কাজ ও যুদ্ধ বিগ্রহের প্রভাবে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থান ও নিদর্শন আজ ধ্বংস হওয়ার ঝুঁকির মুখে রয়েছে। ইতিহাসের অন্যতম স্মারক, ফেনী জেলার সাত মন্দিরের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন।
সাত মন্দিরের উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রায় ১০০ মিটার দীর্ঘ এবং ৮০ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট একটি আয়তাকার পুকুর রয়েছে। যা স্থানীয়ভাবে পোদ্দার পুকুর নামে সুপরিচিত। প্রাচীন এই পুকুরটি সাত মন্দিরের সমসাময়িক নিদর্শন বলে জানা যায়। পুকুরটির উত্তর-পশ্চিম কোণে আরও একটি সুউচ্চ শিখরবিশিষ্ট মন্দির দেখা যায়। এই মন্দিরটিসহ সাত মন্দির বাড়ির মন্দির সংখ্যা হলো ১০টি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সাত মন্দিরসহ তৎসংলগ্ন অন্যান্য মন্দির ও পুকুরটিকে নিয়ে ফেনী জেলায় একটি প্রত্ন-পর্যটন স্থান গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় যে, বিংশ শতাব্দীতে বিনোদ বিহারি নামে ফেনীর ছাগলনাইয়ায় একজন জমিদার ছিলেন। সাত মন্দির বাড়িটি এ জমিদারের প্রতিষ্ঠিত বাড়ি কিংবা তার পৈতৃক বাড়ি (?)। আরও জানা যায়, দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে জমিদার বিনোদ বিহারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় চলে যান। বর্তমানে জমিদার বাড়িটিতে স্থানীয় বাসিন্দারা বসবাস করেন। সম্ভবত, ১৯ ও ২০ শতাব্দীতে জমিদার বিনোদ বিহারির পূর্বপুরুষদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সাত মন্দিরের এসব স্মৃতি মন্দির আলাদা আলাদা সময়ে পর্যায়ক্রমে নির্মাণ করা হয়েছিল।
২০০২ সাল থেকে, ফেনী জেলার এই সাত মন্দির, সাত মঠ নামে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সরকারের সংরক্ষিত পুরাকীর্তির তালিকায় অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই মন্দিরগুলোর তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণ-সংস্কার কাজের মূল দায়িত্ব পালন করে থাকে।
সাত মন্দির দেখতে কিভাবে যাবেন?
কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে ফতেহপুর স্টার লাইন পাম্প স্টেশন হতে ফেনী শহর বাইপাস সড়কপথে পূর্ব দিকে ১৭.৫ কিলোমিটার দূরে এবং ফেনী জেলা শহরের মহীপাল নামক স্থান থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে ছাগলনাইয়া উপজেলা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সাত মন্দির বাড়ি অবস্থিত। সড়কপথে বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, প্রভৃতি গাড়িযোগে খুব সহজে ঐতিহাসিক এই মন্দিরগুলোতে গমন করা যায়। [মো: শাহীন আলম]
তথ্যসূত্র:
১। সাত মঠ, wikipedia.org;
২। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ;
৩। সরেজমিন পরিদর্শনে প্রাপ্ত তথ্য।