বড় শরীফপুর মসজিদ: ইতিহাস, স্থাপত্য ও নিঃশব্দ ঐতিহ্যের সাক্ষ্য | কুমিল্লা
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই ছড়িয়ে আছে অসংখ্য প্রাচীন স্থাপত্য, যেগুলো ইতিহাসের অনুপম দলিল হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। তেমনই একটি স্থাপত্য নিদর্শন হলো বড় শরীফপুর মসজিদ [Video], যা কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত বাইশগাঁও ইউনিয়নের বড় শরীফপুর গ্রামে অবস্থিত। এ মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি একাধারে মুঘল আমলের স্থাপত্যরীতি, ইতিহাস এবং স্থানীয় আধ্যাত্মিক চেতনার প্রতীক।
🔹 অবস্থান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ
মসজিদটি অবস্থিত বিখ্যাত নটেশ্বর দিঘির তীরে। দিঘিটি নিজেই একটি প্রাচীন ও উল্লেখযোগ্য জলাশয়, যা স্থানীয় মানুষদের কাছে ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। দিঘির পাড়ে মসজিদটির অবস্থান নিঃসন্দেহে এক দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ তৈরি করেছে। সবুজ পরিবেশ ও শান্ত জলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটি যেন সময়ের প্রহর গুনে চলছে। মসজিদটির উত্তর-পূর্ব পাশ দিয়ে ডাকাতিয়া নদী প্রবাহিত অবস্থায় রয়েছে।
🔹 স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
বড় শরীফপুর মসজিদ মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন হলেও এর গায়ে নেই জাঁকজমকপূর্ণ অলংকরণ। বরং এটি একটি সাদাসিধা সৌন্দর্য বহন করে, যা একধরনের ধ্যানী ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ তৈরি করে।
-
আয়তাকার মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা-লম্বিভাবে অবস্থিত, যা ১৪.৫০ মিটার দীর্ঘ এবং ৬.০০ মিটার প্রশ্বস্ত;
-
পূর্ব দেয়ালে রয়েছে খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশপথ;
-
উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে রয়েছে একটি করে খিলানযুক্ত জানালা বা প্রবেশপথ;
-
মসজিদ অভ্যন্তরে পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি মিহরাব।
-
ছাদে রয়েছে তিনটি গম্বুজ, মাঝখানের গম্বুজটি তুলনামূলক বড় এবং তার দুই পাশের দুটি গম্বুজ আকারে ছোট; যা মসজিদটিকে আরও আকর্ষণীয় করেছে।
-
দেয়ালগুলো অনেক পুরু ও মজবুত, যা প্রাচীন নির্মাণশৈলীর স্থায়িত্ব নির্দেশ করে।
যদিও মসজিদের দেয়াল বা গম্বুজে কোনো উন্নত কারুকার্য নেই, তবে এর কাঠামোগত বিন্যাস মুঘল যুগের বাস্তবতা ও স্থাপত্যশৈলীর বহিঃপ্রকাশ।
🔹 নির্মাণকাল ও ঐতিহাসিক মতভেদ
মসজিদটির মূল প্রবেশপথের উপরে একটি ও কেন্দ্রীয় মিহরাবের উপরে একটি ফারসি ভাষায় লেখা শিলালিপি রয়েছে। এ শিলালিপি দুটি পদ্য রূপে রচিত এবং সাংকেতিক ভাষায় মসজিদটির নির্মাণ তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়।
-
একদল মনে করেন, এটি নির্মিত হয় ১০৬৮ হিজরি (১৬৫৭–৫৮ খ্রিস্টাব্দে); এবং
-
আবার ১৯৭৭ সালের কুমিল্লা জেলা গেজেটিয়ার মতে, মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে।
এ মতবিভেদ সত্ত্বেও, মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী ও গঠনভঙ্গি মুঘল আমলের দিকেই ইঙ্গিত করে।
🔹 নির্মাতা ও স্থানীয় ইতিহাস
গেজেটিয়ার অনুসারে, মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন মোহাম্মদ হায়াত নামক একজন কোতোয়াল। সে কারণে স্থানীয়ভাবে একে “কোতোয়ালী মসজিদ” নামেও ডাকা হয়।
তবে স্থানীয় লোককথা ও ইতিহাস অনুযায়ী, এ এলাকায় এক সময় শাহ সৈয়দ বাগদাদী নামে একজন বিখ্যাত দরবেশ বসবাস করতেন। তাঁরই একজন প্রিয় শিষ্য আবদুল করিম, সুলতান শাহ্ শুজা’র সুবাদারিকালে এ মসজিদ নির্মাণ করেন বলে বিশ্বাস করা হয়।
এ দুটি বর্ণনার মধ্যে যেটিই সত্য হোক না কেনো, মসজিদটি আজও এক জীবন্ত ইতিহাস, যা আমাদের অতীতকে মনে করিয়ে দেয়।
🔹 আজকের প্রেক্ষাপটে বড় শরীফপুর মসজিদ ও সংরক্ষণ কার্যক্রম
বর্তমানে বড় শরীফপুর মসজিদ শুধু নামাজ আদায়ের স্থানই নয়, এটি ইতিহাসপ্রেমী, পর্যটক এবং গবেষকদের কাছেও এক আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। ঐতিহাসিক স্থাপনাটি তার ধর্মীয় ও স্থাপত্যিক গুরুত্বের কারণেই ১৯৪৬ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় রয়েছে এবং তাদের তত্ত্বাবধানে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। স্থানীয়দের কাছে এ মসজিদটি শুধু একটি ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, বরং এটি অঞ্চলটির গৌরবময় ইতিহাসের অংশ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত।
🧾 সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
বড় শরীফপুর মসজিদ শুধু একটি ইটের নির্মাণ নয়; এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার প্রতীক এবং বাংলার মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। শতাব্দী পেরিয়ে আসা স্থাপনাটি আজও দাঁড়িয়ে আছে—নটেশ্বর দিঘির পাড়ে, নীরব ভাষায় বর্ণনা করছে অতীতের গৌরবময় সময়ের কথা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ মসজিদ মানুষকে না শুধু ধর্মীয় চর্চায় পথ দেখিয়েছে, বরং ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়তে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে এসেছে।
✍️লেখক: মো. শাহীন আলম
📚 তথ্যসূত্র (References)
-
যাকারিয়া, আবুল কালাম মোহাম্মদ (২০১০)। বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ । পৃষ্ঠা ৬৭৬। দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা।
-
লেখকের নিজস্ব সরেজমিন পরিদর্শন ও তথ্যচিত্র, বড় শরীফপুর মসজিদ, লাকসাম, কুমিল্লা।
-
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর (সংরক্ষিত পুরাকীর্তি তালিকা ও তত্ত্বাবধান সংক্রান্ত তথ্য)।
ওয়েগনারের মহাদেশ সঞ্চালন তত্ত্ব