বাংলালিপি ও শিলালিপির ইতিহাস

বাংলালিপি বিবর্তনের সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রাচীন ভারতে দু’টি লিপির কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি হলো ব্রাহ্মী লিপি, অপরটির নাম খরোষ্টি লিপি। ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা হতো বাম থেকে ডানদিকে, এবং খরোষ্টি লিপিতে লেখা হতো ডান থেকে বামে। খরোষ্টি লিপি গৃহীত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আরামিক লিপি থেকে। তবে এ লিপির ব্যবহার ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ।

ভারতবর্ষের প্রাচীনতম ব্রাহ্মীলিপি থেকেই বাংলালিপি বিকশিত হয়েছে। ব্রাহ্মী থেকে ভারতবর্ষে বিভিন্ন আঞ্চলিক লিপি; যেমন – নাগরী, সারদা, টাকরী, গ্রন্থ, গুরুমুখী, গুজরাতী, তামিল, তেলেগু, উড়িয়া, মালয়, কানেড়ী, বাংলা, তিব্বতি, সিংহলী, বর্মী, প্রভৃতির উদ্ভব হয়েছে। আর হস্তলিখিত লিপিতে লেখকের রুচিভেদে কালক্রমে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হয়ে থাকে। বাংলায় প্রাচীন ব্রাহ্মীতে উৎকীর্ণ প্রধানত দু’টি নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে – একটি মহাস্থান লিপি, অপরটি ফেনী জেলায় প্রাপ্ত শিলুয়া মূর্তিলেখ। তবে মহাস্থান লিপিটি বাংলায় প্রাপ্ত ব্রাহ্মীর প্রাচীনতম নিদর্শন।

সপ্তম শতকে বাংলালিপি বিবর্তনকালে বাংলা অঞ্চলের লিপিতে মধ্যগাঙ্গেয় অঞ্চলের কুটিল লিপির প্রভাব লক্ষ করা যায়। বর্ণের বাঁক নেয়া রীতির (কুটিল আকৃতি অক্ষরের) কারণে এ সময়ের লিপির কুটিল নামকরণ করা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার নাথ, রাত ও খড়গ রাজাদের লিপিতে কুটিল লিপির প্রচলন ঘটেছিল।

বাংলালিপির বিবর্তন

বাংলা লিপির বিবর্তনের ইতিহাসে অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাংলার লিপিতে উত্তর ভারতীয় নাগরী লিপির প্রভাব পড়ে, তখন বাংলায় লিপি নতুন রূপ লাভ করে, যাকে লিপিবিদ্যাবিশারদগণ ‘প্রোটো-নাগরী’ (proto-nagari) লিপি বলে অভিহিত করেছেন। ঐ সময়ে লিপি পরিবর্তনের মূলে ছিল বাংলা, বিহার ও উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাল রাজবংশের উদ্ভব ও শাসন। তখন এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও ভাবের আদান-প্রদানে বিপ্লব ঘটে এবং শিল্পকলা ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। এ সাংস্কৃৃতিক পরিবর্তন বাংলা অঞ্চলের লিপির চেহারা বদলে দেয়। কুমিল্লার ময়নামতির আদি দেব (early deva) রাজাদের লিপিতে ও চন্দ্রলিপিতে প্রোটো-নাগরী লিপির প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে বলে গবেষকগণ মনে করেন।

বাংলালিপি বিবর্তনের চূড়ান্ত ধাপটি লক্ষ করা যায় এগারো ও বারো শতাব্দীতে, যে সময়ে লিপি প্রোটো-বাংলা থেকে বাংলায় রূপান্তর ঘটেছে। সেন বংশের শাসন যুগের শেষ দিকে লিপি পরিবর্তনের এ রূপরেখা ধরা পড়ে। লক্ষ্মণসেনের তাম্রলিপিতে বাংলা লিপির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। বারো শতাব্দীর পরে বাংলায় আর কোনোও তাম্রলিপি পাওয়া যায়নি। তেরো শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সতেরো শতাব্দী পর্যন্ত পুঁথি (পাণ্ডুলিপি) পাওয়া যায়। এসব পুঁথি থেকে বাংলা লিপির পূর্ণাঙ্গ রূপ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠে।

সুতরাং বাংলা লিপি হলো পূর্ব-ভারতীয় ব্রাহ্মীলিপির সূদীর্ঘ আঞ্চলিক বিবর্তন ধারার চূড়ান্তরূপ। ব্রাহ্মী থেকে উদ্ভব হলেও বর্তমানে ব্রাহ্মী হরফের সাথে বাংলা লিপির তেমন কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। আঞ্চলিক লিপিকারদের হাতে ক্রমশ পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা লিপি স্বতন্ত্র সত্তা লাভ করেছে। স্বরবর্ণের চিহ্নগুলির আলংকারিক বাঁক নেয়া রূপ বাংলার লিপিকারগণের নিজস্ব উদ্ভাবন। বাংলা লিপি থেকেই উদ্ভব হয়েছে নেপালী ও অসমীয়া বা অহম লিপির। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষাভাষী জনগণের নিকট ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বাংলা লিপি বহুল প্রচলিত।

শিলালিপি হলো বিভিন্ন স্থাপনার গায়ে সাঁটা পাথরে উৎকীর্ণ লিপি। প্রধানত ধর্মীয় স্থাপনার (যেমন: মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, সমাধি, মঠ, প্রভৃতির) গায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিলালিপি উৎকীর্ণ থাকতে দেখা যায়। ধর্মীয় স্থাপনায় সংযুক্ত শিলালিপি ছাড়াও লৌকিক ইমারতে কিছু সংখ্যক শিলালিপি পাওয়া যায়। সুলতানি বাংলায় (১২০৪-১৫৩৮ সালে) প্রাপ্ত শিলালিপি ছিল সাধারণত আরবিতে উৎকীর্ণ। ফারসি লিপির সংখ্যা ছিল খুবই কম।

শিলালিপি

মধ্যযুগে বাংলার শিলালিপি মুসলিম ক্যালিগ্রাফি বা হস্তলিখন শিল্পানুসারে লেখা হতো। আরবি ক্যালিগ্রাফির ক্রমবিকাশের ধারাক্রম মধ্যযুগে বাংলার শিলালিপিতেও দেখা যায়। মধ্যযুগের লিপি সাক্ষ্য প্রধানত প্রাচীন স্থাপনার গায়েই পাওয়া গিয়েছে। অধিকাংশ লিপি ছিল আরবি ও ফারসি ভাষায় লেখা। বাংলা লিপি ছিল হাতেগোণা। সমকালীন ইতিহাস চর্চায় এবং মধ্যযুগের ইতিহাস পুনর্গঠনে এসব লিপি সাক্ষ্যের বিশ্লে­ষণ প্রয়োজন হয়। উপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয়দের আগমনের সাথে সাথে আরবি ও ফারসি শিলালিপি ছাড়াও ইংরেজি এবং গ্রিক ভাষায় উৎকীর্ণ শিলালিপি গির্জা, ইউরোপীয়দের বসত বাড়ি এবং গ্রিক ও ইংরেজ সমাধিতে দেখা যায়। দেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা জমিদার বাড়ি, মন্দির ও মসজিদে অনেক সময় পরিচয় জ্ঞাপক কয়েকটি শব্দ বা নির্মাতার নাম ও নির্মাণ তারিখ বাংলা লিপিতে লেখা হয়েছে। [মো: শাহীন আলম]


সহায়িকা ও ছবি:
১। বাংলালিপি, banglapedia.org
২। শিলালিপি, banglapedia.org


বাংলালিপির উদ্ভব ও বিকাশ এবং শিলালিপির ইতিহাস


Leave a Reply