ভূগোল: পৃথিবী ও মানুষের সম্পর্কের বিজ্ঞান
ভূগোল শব্দের আভিধানিক অর্থ অনুসারে, ভূগোল হলো পৃথিবী এবং এর অধিবাসী মানুষের সমীক্ষা। একটু সহজভাবে বললে, ভূগোল হলো মানুষের আবাসস্থল হিসেবে পৃথিবীর বিশ্লেষণ। ইংরেজ ভূগোলবিদ Monkhouse বলেন—
“মানুষের আবাস হিসেবে পৃথিবীর পৃষ্ঠের স্থানিক পার্থক্যের (spatial differentiation) বিশ্লেষণ নিয়েই গঠিত হয়েছে ভূগোল।”
অর্থাৎ, ভূগোল শুধু ভূ-পৃষ্ঠের গঠন নয়, বরং সেখানে মানুষের বসবাস, কর্মকাণ্ড এবং পরিবেশের পারস্পরিক সম্পর্কও এর আলোচ্য বিষয়। ভূগোল সম্পর্কে অন্যান্য ভূগোলবিদ যেসব মত দেন—
- স্ট্যাবো (Strabo, 10 BC) মতে ‘ভূগোল আমাদের শেখায় পৃথিবীর জল ও স্থলের সমস্ত জীব সম্পর্কে, একই – সাথে ব্যাখ্যা করে পৃথিবীর বৈশিষ্ট্যগুলোকে।’
- টলেমি (Ptolemy, 85 BC – 165 CE) মতে, ‘ভূগোল সেই মহান বিষয় যা মহাবিশ্বের মধ্যে পৃথিবীর এক ঝলক দেখায়।’
- রিচার্ড হার্টশোর্ন (Richard Hartshorne, 1899-1992) মতে, ‘ভূপৃষ্ঠের বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যাবলির সঠিক, শ্রেণিবদ্ধ এবং যুক্তিসঙ্গত বর্ণনা এবং বিশ্লেষণই ভূগোলের আলোচ্য বিষয়।’
- পিটার হ্যাগেট (Peter Haggett, 1981) বলেন, ‘যে শাস্ত্র ভূপৃষ্ঠকে মানবগোষ্ঠীর বসবাসের স্থান হিসেবে অধ্যয়ন করে তা-ই ভূগোল।’
- ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant, 1795) বলেন, ‘ভূগোল হচ্ছে পৃথিবীর সমীক্ষা। এটি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করে খুঁজে পায়।’
- আলেকজান্ডার ফন হামবোল্ট (Alexander von Humboldt, 1769-1859) বলেন, ‘ভূগোল প্রকৃতিতে বিজ্ঞানের সম্বন্ধ স্থাপন করে, যাতে পৃথিবীতে যা কিছু পাওয়া যায়, তার সমীক্ষা ও বর্ণনা করা হয়।’
- কার্ল রিটার (Carl Ritter, 1779-1859) এর মতে, ‘ভূগোল হলো বিজ্ঞানের সেই শাখা যা পৃথিবীর সমস্ত বিষয়, বৈশিষ্ট্য ও সম্পর্কসহ তাকে পৃথক একটি একক হিসেবে বিচার করে এবং সৃষ্টিকারী মানুষের সাথে এ সার্বিক ঐক্যের যোগসূত্র তুলে ধরে।’
- Anlechin, V.A (1973): Geography is concerned with the existing material system forming the geographical sphere of the earth as an environment for the actual or potential development of human society, together with the material aspects of social development expressed in its regional complexes within the geographical environment.
- Anonymous (1990): Geography is the study of relationship between man and his environment through space and time.
- L. Dudley Stamp (1966) তাঁর ভূগোল অভিধানে ভূগোলের তিনটি প্রধান দিক উল্লেখ করেছেন:
- পৃথিবী ও তার অধিবাসীদের বর্ণনা,
- মানুষের পরিস্থিতি ও পরিবেশের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, ও
- ভূপৃষ্ঠের বৈচিত্র্য ও অঞ্চলগত সম্পর্কের ব্যাখ্যা।
ভূগোলের বিবর্তন
ভূগোলের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উনিশ শতকের আগ পর্যন্ত এ শাস্ত্রের মূল মনোযোগ ছিল প্রাকৃতিক উপাদান, যেমন—পর্বত, নদী, জলবায়ু ইত্যাদির উপর। মানুষের ভূমিকাকে তখন তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
তবে এ প্রবণতায় পরিবর্তন আসে আলেকজান্ডার হুমবোল্ট ও কার্ল রিটার-এর মতো প্রখ্যাত ভূগোলবিদদের মাধ্যমে। হুমবোল্ট প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে অগ্রণী হলেও কার্ল রিটার মানবসমাজকেও ভূগোলের আলোচনায় যুক্ত করেন। এ থেকেই শুরু হয় মানব-পরিবেশ সম্পর্কভিত্তিক ভূগোল।
এরপর থেকে প্রায় সব আধুনিক ভূগোলবিদ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
আধুনিক ভূগোলে মানুষের ভূমিকা
বিংশ শতাব্দীতে মানুষের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর তার নিয়ন্ত্রণকে বাড়িয়ে তোলে। মানুষ এখন পরিবেশকে শুধু মেনে চলে না, বরং পরিবেশকে বদলিয়ে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করে।
তবে এ পরিবর্তনের মাঝেও এক প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে—পরিবেশগত ভারসাম্য কীভাবে বজায় রাখা সম্ভব? কারণ, প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না।
এজন্যই আধুনিক ভূগোলবিদগণ জোর দিচ্ছেন—
সময় ও স্থানের প্রেক্ষাপটে মানুষের কর্মকাণ্ড এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণেই ভূগোলের মূল বিষয়বস্তু নিহিত।
ভূগোলের গুরুত্ব
আজকের পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, নগরায়ন, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের সংকটসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এসব সমস্যা বোঝা এবং সমাধানে ভূগোল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ভূগোল একদিকে যেমন প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, তেমনি মানববিদ্যা। এ দ্বৈত চরিত্রই একে অনন্য করে তুলেছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, ভূগোল এখন আর কেবল পাহাড়-নদী চেনার বিষয় নয়। এটি এক জটিল অথচ প্রয়োজনীয় জ্ঞানের শাখা, যা আমাদের শেখায়—
-
পরিবেশকে কীভাবে বুঝতে হয়,
-
মানবজীবনের উপর প্রকৃতির প্রভাব কী,
-
এবং মানুষ ও প্রকৃতি কীভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
সুতরাং, ভূগোলকে জানার অর্থ শুধুই মানচিত্র পড়া নয়, বরং একটি টেকসই ভবিষ্যতের পথে নিজেকে প্রস্তুত করা।
✍️ লেখক: মো. শাহীন আলম
🔗 সহায়িকা:
১। Singh, Savindra, (2009), Physical Geography, Prayag Pustak Bhawan, Allahbad, India;
২। রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, (২০১৭ – ২০১৮), কবির পাবলিকেশনস, ঢাকা;
৩। রউফ, কাজী আবদুর, (২০০২), প্রাকৃতিক পরিবেশ, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা;
৪। রউফ, কাজী আবদুর, (২০১১), প্রাকৃতিক ভূগোল পরিচিতি, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা।
Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL
দ্রাঘিমারেখার ব্যবহার: যে কোনো স্থান-দেশের সময়ের পার্থক্য নির্ণয়
ওয়েগনারের মহাদেশ সঞ্চালন তত্ত্ব
Tags: ভূগোল, শিক্ষা, পরিবেশ, প্রাকৃতিক ভূগোল, ছাত্রছাত্রীদের জন্য।