মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও এদের শ্রেণীবিভাজন
মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড:
মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রতিদিন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে সব কাজ করে থাকে, সে সব কাজকে সম্মিলিতভাবে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড (economic activities) বলে। অর্থাৎ মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হল মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অর্থ উপার্জন, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং ধন-সম্পদ লাভের সাথে সম্পর্কিত কাজ। যেমন- পশু শিকার, পশু পালন, কৃষিকাজ, মৎস্যপালন, খনিজ সম্পদ উত্তোলন, শিল্পকারখানায় শিল্পজাত পণ্যদ্রব্য উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি। এসব কাজের মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়। তাই এসব কাজকে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে। সময়ের আবর্তনের সাথে মানুষের সমাজ জীবনের ধারা ও অর্থনীতি (economy) পরিবর্তিত হয় এবং মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও পরিবর্তিত হয়।
পৃথিবীতে আগমনের পর থেকে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য মানুষ বিভিন্ন ধরনের কাজ করে আসছে। যুগে যুগে মানুষের অবস্থার উন্নতির প্রয়োজনে এসব কাজ করতে হয়েছে। আবার মানুষের এসব অর্থনৈতিক কাজ যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, আদিমযুগে মানুষের একমাত্র কাজ ছিল খাদ্য সংগ্রহ করা, এ সময় মানুষ পশু শিকার ও মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। সাধারণত এ সময়কে খাদ্য সংগ্রহের যুগ বলা হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে পশুপালন ও কৃষিকাজের মাধ্যমে মানুষ খাদ্য উৎপাদনের যুগে পর্দাপণ করে। তার আরো পরে মানুষ ব্যবসায়, শিল্প কলকারখানায় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। এর ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তিত হয়।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শ্রেণীবিভাগ:
মানুষের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বা কর্মকান্ডের ধারাকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়। যেমন-
১. প্রাথমিক পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড
২. দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও
৩. তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।

১. প্রাথমিক পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড: মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রতিদিন প্রকৃতি থেকে সরাসরি বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য আহরণ বা সংগ্রহ করে। প্রকৃতি থেকে এ ধরনের সরাসরি আহরণ বা সংগ্রহ করার কাজগুলো হল প্রাথমিক বা প্রথম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। মানুষ যখন থেকে বুঝতে পারল যে, মাটি তাদের খাদ্য দিতে সক্ষম, তখন তারা নদীর তীরবর্তী উর্বর ভূমির জঙ্গল পরিস্কার করে। নদীর তীরবর্তী এ ভূমিতে গাছ লাগান ও ফসলের বীজ বপন করে ফসল উৎপাদন করতে শুরু করে। এভাবে এক সময় যাযাবর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এক পর্যায়ে কৃষি কাজের জন্য মানুষ পৃথিবীর সব জায়গায় বসবাস করতে শুরু করে। সময়ের আবর্তনে মানুষ মেধাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ নিজ প্রয়োজনে অধিকতর কার্যকর করে তুলতে থাকে। ভূপৃষ্ঠের নিচ থেকে বিভিন্ন ধাতব ও অধাতব খনিজ, যেমন- কয়লা , খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি সংগ্রহ করে নিজের অভাব মোচন করতে সক্ষম হয়। পশু শিকার, মাছ শিকার, গাছ হতে রস সংগ্রহ, মধু সংগ্রহ, কৃষিকাজ, পশুপালন, কাঠচেরাই, খনিজ সম্পদ উত্তোলন প্রভৃতি প্রকৃতি থেকে আহরণ বা সংগ্রহ করার কাজ। আর এসব কাজ মানুষের প্রাথমিক পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অন্তর্ভুক্ত।

২. দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড: প্রাথমিক পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে উৎপাদিত বা প্রাপ্ত পণ্যদ্রব্যগুলোকে মানুষ যে সব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আকার পরিবর্তন এবং উপযোগ বৃদ্ধি করে, সে সব কাজকে দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বা ক্রিয়াকলাপ বলে। যেমন- কৃষি কাজের মাধ্যমে উৎপাদিত তুলা থেকে সুতা, কাপড়, জামা প্রভৃতি এবং পাট থেকে সুতলি, চট, বস্তা, কার্পেট প্রভৃতি। পশুর পশম থেকে গরম কাপড়, কম্বল, শাল এবং রেশম পোকার মাধ্যমে উৎপাদিত তন্তু থেকে সুতা, রেশমী কাপড় প্রভৃতি। বনভূমি থেকে আহরিত কাঠের আকার পরিবর্তন করে আসবাবপত্র এবং নরম কাঠ, ঘাস ও বাঁশ থেকে মন্ড, কাগজ, হার্ডবোর্ড, নাইলন, সেলুলয়েড, প্লাস্টিক প্রভৃতি। আবার খনি হতে প্রাপ্ত লৌহ আকরিকের আকার পরিবর্তন করে পেরেক, লৌহজাত শলাকা, লোহার রড, লোহার সাথে অন্য ধাতু মিশিয়ে ইস্পাত এবং ইস্পাত থেকে মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, জাহাজ, কলকব্জা, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি কর্মকাণ্ডসমূহ হল মূলত দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড।

৩. তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড: সাধারণত যে কোন সেবামূলক কাজকে তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বা ক্রিয়াকলাপ। অর্থাৎ কোন প্রকার উৎপাদন না করে কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কাজের মাধ্যমে প্রাপ্ত পণ্যদ্রব্যগুলো বিভিন্ন উপায়ে চাহিদাপূর্ণ এলাকায় ভোক্তার কাছে সরবরাহ করাকে তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বলে। দোকানী বা পণ্যবিক্রেতা, বই প্রকাশক, বই বিক্রেতা, কোন সেবা প্রদানকারী কোম্পানির প্রতিনিধি, ব্যাংকার, ফেরীওয়ালা প্রভৃতির কাজ এ পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত।

ঝাড়–দার পরিষ্কার করেন, মুচি জুতা সেলাই করেন, নাপিত চুল ছাঁটেন, ধোপা কাপড় ধোলাই করেন, খেয়াঘাটের মাঝি যাত্রী ও পণ্য পারাপার করেন, ব্যবসায়ী উদ্বৃত্ত এলাকা থেকে পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে চাহিদাপূর্ণ ঘাটতি এলাকায় সরবরাহ করেন; রেলগাড়ি চালক, বাস চালক, ট্রাক চালক, লঞ্চের সারেং, নৌকার মাঝি, রিক্সা চালক, ঠেলা গাড়িওয়ালা পন্যদ্রব্য ও যাত্রী স্থানান্তর করেন, শিক্ষক পাঠদান করেন, আইনজীবী আইনী সেবা প্রদান করেন, চিকিৎসক চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। এদের সবাই সেবামূলক কাজের মাধ্যমে অর্থ উপাজন করেন। আর এদের প্রত্যেকের কাজই হল তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। [মো. শাহীন আলম]
Follow Us in Our YouTube channel: GEONATCUL
লেখাটি পড়ে অনেক উপকৃত হলাম। ভবিষ্যতে আরও লেখা প্রত্যাশা করছি।