মুঘল স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন: ফেনীর মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদ
মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন, মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদ, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা ফেনীর সদর উপজেলায় শর্শাদী নামক গ্রামে অবস্থিত। ডাকাতিয়া নদীর সন্নিকটে পূর্ব অববাহিকায় অবস্থিত প্রাচীন এই মসজিদ স্থানীয়ভাবে তিনগম্বুজ মসজিদ নামে সুপরিচিত। অনেকেই এই মসজিদটিকে জমিদার মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর মসজিদ নামেও চিনে থাকেন।
মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদ মুঘল স্থাপত্য রীতিতে নির্মাণ করা হয়েছে। আয়তাকার পরিকল্পনায় নির্মিত মসজিদের ছাদে তিনটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের পরিমাপ উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৬ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৭ মিটার এবং দেয়ালগুলো প্রায় ১ মিটার চওড়া। মসজিদ স্থাপত্যের প্রাচীন এ নিদর্শন নির্মাণে চুন, সুরকি এবং পোড়ামাটির ইট ব্যবহার করা হয়েছে।
মসজিদটির চারকোণে একটি করে ৪টি স্তম্ভ বা টারেট (turret) রয়েছে। অষ্টভূজাকার স্তম্ভগুলোর উপরে একটি করে অনুগম্বুজ দেখা যায়। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে ৩টি প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদের ছাদের প্রতিটি গম্বুজের উপরে উল্টানো পদ্ম-কলস (inverted lotus pitcher) নকশায় শোভিত চূড়া (finial) রয়েছে।
মসজিদের অভ্যন্তর দেয়াল জুড়ে বিভিন্ন ধরনের ফুল ও জ্যামিতিক নকশা দেখা যায়। এটির পশ্চিম দেয়ালের মাঝখানে ১টি মিহরাব ছিল। মিহরাবটিকে ভেঙ্গে বর্তমানে পশ্চিম দিকে একটি প্রবেশপথ তৈরি করা হয়েছে। এই প্রবেশপথে পশ্চিম পাশে নবনির্মিত দোতলা মসজিদে গমন করা যায়। এছাড়া, মাঝখানের কেন্দ্রীয় মিহরাবটির উভয় দিকে আরও ৪টি করে মোট ৮টি মিহরাব দেখা যায়। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে ১টি করে প্রবেশপথ এবং ২টি করে কুলঙ্গি দেখা যায়।
মসজিদের সামনে রয়েছে পাকা মেঝেবিশিষ্ট আঙ্গিনা (courtyard)। আঙ্গিনাটির দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব কোণে ১টি করে কক্ষ রয়েছে। এক গম্বুজবিশিষ্ট কক্ষদ্বয় অষ্টভূজাকার (octagonal) পরিকল্পনায় নির্মিত। মসজিদ আঙ্গিনার সামনে রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার খিলানবিশিষ্ট একটি প্রবেশ তোরণ।
মসজিদটির স্থাপত্যিক কাঠামোর সাথে কুষ্টিয়ার ঝাউদিয়া শাহী মসজিদের স্থাপত্য নকশার বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এরূপ মুঘল স্থাপত্য রীতির তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় কম বেশি দেখা যায়, যা সংখ্যায় খুবই কম।
বিশ্বায়নের এই যুগে আধুনিক উন্নয়নমূলক কাজের প্রভাবে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থান ও নিদর্শন আজ ধ্বংস হওয়ার ঝুঁকির মুখে রয়েছে। ফেনীর জেলার প্রাচীন নিদর্শন মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদটির গাঁ ঘেষে পশ্চিম দিক দিয়ে আধুনিক দোতলা মসজিদ এবং উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে মাদ্রাসার বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম নিদর্শন, ফেনী জেলার মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদটির ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় যে, মুঘল শাসন আমলে ১৭ শতাব্দীর শেষ দিকে জনৈক মুঘল নায়েব বা কোনো কর্মকর্তা ফেনী অঞ্চলে এই তিনগম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন। এরপর ১৮ শতাব্দীতে অর্থাৎ ১৭৬২ সালে মোহাম্মদ আলী চৌধুরী ফেনী অঞ্চলে মুঘল নায়েব হিসেবে নিয়োগগপ্রপ্ত হন। কয়েক দশকের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সুনাম ও খ্যাতি ফেনী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হলে ব্রিটিশ শাসকদের সাথে ধীরে ধীরে তাঁর বৈরী সম্পর্কের সৃষ্টি হয়।
এই বৈরিতা বিদ্রোহে রূপ নিলে ১৭৯০ সালে তাঁর ফৌজদারি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয় এবং মোহাম্মদ আলী চৌধুরী এই অঞ্চলে তাঁর কর্তৃত্ব হারান। তবে তাঁর প্রতি এ অঞ্চলের জনগণের ভালোবাসা রয়ে যায়। জানা যায়, জনগণ তাঁকে ‘বীর মুজাহিদ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
সেই সাথে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে মুঘল আমলে নির্মিত এই মসজিদটিকে মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদ নামে নামকরণ করা হয়। তাঁর সময়ে তিনি এই অঞ্চলে অনেক স্থাপনা নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। মসজিদের শিলালিপি অনুসারে, এই মসজিদের নির্মাণকাল ১৬৯০ থেকে ১৬৯১ সাল। বর্তমানে তিনগম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদের চার পাশে গড়ে উঠেছে শর্শাদী দারুল উলুম মাদ্রাসা। ১৯৪৩ সালে শাহ সুফি নুর বখশ (রহ.) মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়।
১৯৯৫ সাল থেকে মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদ জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংরক্ষিত পুরাকীর্তির তালিকায় অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই মসজিদের তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণ-সংস্কার কাজের মূল দায়িত্ব পালন করে থাকে।
মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদটি দেখতে কিভাবে যাবেন?
মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদটি কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে মোহাম্মদ আলী বাজার হতে পশ্চিম দিকে ২.৫ কিলোমিটার দূরে শর্শাদী গ্রামে দারুল উলুম মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে অবস্থিত। মোহাম্মদ আলী বাজারটি কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার এবং ফেনী জেলা শহরের মহীপাল নামক স্থান থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সড়কপথে বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, প্রভৃতি গাড়িযোগে খুব সহজে ঐতিহাসিক এই মসজিদে গমন করা যায়। [মো: শাহীন আলম]
তথ্যসূত্র:
১। মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদ, Wikipedia.org;
২। মুফতি মোহাম্মদ তাসনীম, মোগল স্থাপত্য মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদ, দেশ রূপান্তর;
৩। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ;
৪। সরেজমিন পরিদর্শনকালে প্রাপ্ত তথ্য।