রামুর প্রাচীন লাওয়ে জাদি | কক্সবাজার
বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলাধীন রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের লট উখিয়ার ঘোনা নামক গ্রামের জাদি পাহাড়ে বা উখিয়ার ঘোনা পাহাড়ে লাওয়ে জাদি অবস্থিত। এ জাদিটি (Jadi) মূলত বৌদ্ধ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী ১টি সমাধী মন্দির বা স্মৃতিস্তম্ভ বা বৌদ্ধ স্তুপ (Buddhist Stupa)। কক্সবাজারের জাদি পাহাড়ের বা উখিয়ার ঘোনা পাহাড়ের লাওয়ে জাদিটির ভূ-স্থানাঙ্ক বা জিও কো-অর্ডিনেট (GeoCoordinate) হল 21°26’07.3″N 92°07’15.4″E (21.435360, 92.120934)।
উখিয়ার ঘোনা পাহাড়ের লাওয়ে জাদিটি বর্গাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত। যার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ১০.৫৭ মিটার। জাদিটির নিচের অংশে রয়েছে একটি নিরেট (solid) এবং উচুঁ বর্গাকার ভিত (square-base)। উঁচু ভিতটির চারপাশের প্রতিটি বাহুতে জ্যামিতিক নকশাযুক্ত প্যানেল (panel) রয়েছে। উচুঁ বর্গাকার ভিতটির উপরে রয়েছে একাধিক ধাপবিশিষ্ট বহুভুজের চত্বর (terrace)। এ চত্বরের উপরে রয়েছে ঘন্টা (bell) আকৃতির নকশা।
ঘণ্টা নকশাটির উপরে রয়েছে উল্টানো বাটি (inverted bowl) নকশা। বাটি নকশার উপরে রয়েছে খোদিত বন্ধনী (embossed bands) বা কুণ্ডলী (spire) নকশা। খোদিত বন্ধনী (embossed bands) উপরে রয়েছে পদ্ম পাপড়ি (lotus petal) নকশা। পদ্ম পাপড়ি নকশার উপরে রয়েছে কলার কুঁড়ি (banana bud) আকৃতির নকশা। কলার কুঁড়ি (banana bud) নকশার উপরে রয়েছে ১টি টোপর বা মুকুট (crown)। অতীতে কারুকার্যময় টোপরের চারপাশ ঘিরে ঝুলে ছিল ছোট ছোট পিতলের ঘন্টা। জানা যায় যে, বাতাসে ঘন্টাগুলো টুং টাং আওয়াজ করতো। বর্তমানে ঘন্টাগুলোর বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে গেছে।
আরও জানা যায়, অতীতে এ জাদিটির পাদদেশের দক্ষিণ পাশে বিহার, পুকুর ও চেরাংঘর ছিল। বর্তমানে এসবের কোন কিছু দেখা যায় না। এছাড়া পাহাড়ের দক্ষিণপাশ দিয়ে জাদিতে আরোহণ করার জন্য ১টি সিঁড়ি পথ ছিল। এখন কেবল দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ দিয়ে পাহাড়ের গাঁ বেয়ে সরু পথে পাহাড়ের চূড়ায় লাওয়ে জাদিটিতে পৌঁছানো যায়।
ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমান উখিয়ার ঘোনা গ্রামের পূর্বে নাম ছিল লাওয়ের ঘোনা। আরাকান রাজ্যের প্রধান সেনাপতি লাওয়ে ম্রেন বা মোরং নাম থেকে লাওয়ে নামটি নেয়া হয়েছে। বার্মিজ (বর্তমান মিয়ানমার) রাজার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে লাওয়ে মোরং তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে রামুর হাইটুপীতে এসে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে লাওয়ে মোরং-এর নামানুসারে লাওয়ের পাড়া বা লাওয়ের ঘোনা নামকরণ করা হয়। আর লাওয়ের পাড়ায় বা লাওয়ের ঘোনায় (বর্তমান উখিয়ার ঘোনায়) অবস্থিত পাহাড়ের মাথায় যে জাদি (স্তুপ) নির্মাণ করা হয়, তার নামকরণ করা হয় লাওয়ে জাদি।
আনুমানিক ১৭১০ সালে সেনাপতি লাওয়ে মোরং এ লাওয়ে জাদিটি নির্মাণ করেন। আরও জানা যায়, সর্বপ্রথম নির্মাণকালে এ জাদিটির আকার খুবই ছোট ছিল। পরবর্তীকালে খিজারি দালালের জেঠা মংপ্রু বৈদ্য বা সাকটাং-এর পিতা এ জাদিটির প্রথম সংস্কার কাজ সম্পন্ন করেন। জনৈক ব্যক্তি দানবীর দঅং দালাল ১৯০০ সালে জাদিটির আকার বড় করেন। একই সাথে তিনি জাদিটির চারপাশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেন। ১৯৫০ সাল থেকে প্রচুর লোকের সমাগমসহ এ জাদিটিতে বাৎসরিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। যা বর্তমানে দেখা যায় না। পাহাড়ের চূড়ায় অনেক সমতল জায়গা নিয়ে এ জাদিটি নির্মিত হলেও নিয়মিতভাবে মাটি ক্ষয়ের ফলে জাদিটির চারপাশের সীমানা প্রাচীর ধ্বসে পড়েছে এবং পাহাড়ের চূড়ার সমতল ভূমির পরিমাণ কমে এসেছে। বর্তমানে জাদিটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। [মো. শাহীন আলম]
তথ্যসূত্র:
১. বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা কক্সবাজার, (জুন, ২০১৪), ঢাকা: বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা ৭০-৭২।
২. প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ।
কক্সবাজার রামুর প্রাচীন লাওয়ে জাদি
Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL