রূপবান মুড়া মন্দির ও বিহার | কুমিল্লা
রূপবান মুড়া মন্দির ও বিহার
রূপবান মুড়া মন্দির ও বিহার বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত লালমাই-ময়নামতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। কুমিল্লা-কালির বাজার সড়কের দক্ষিণে বর্তমান বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মাঝখানে একটি পাহাড়ের উপরে এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি অবস্থিত।
বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক ধারাবাহিক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধানের ফলে এখানে মাঝারি আকারের প্রায় ক্রুশাকৃতির একটি আকর্ষণীয় সমাধি মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। এর সাথে এখানে বৌদ্ধ বিহার, অষ্টকোণাকৃতির স্তুপ এবং বর্গাকৃতির ভিতের উপর আর একটি স্তূপসহ বেশ কয়েকটি প্রাচীন কাঠামো উন্মোচিত হয়েছে। প্রথানুযায়ী পূর্বদিকে মন্দিরের প্রবেশপথ এবং এর সামনে বিহারের প্রবেশপথ অবস্থিত।

প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে রূপবান মুড়া প্রত্নস্থানে উন্মোচিত মন্দির ও বিহার স্থাপত্যিক কাঠামোর নির্মাণ, সংস্কার ও পুনঃনির্মাণের তিনটি পর্যায় পরিলক্ষিত হয়েছে বলে জানা যায়। এখানে আদিতে ক্রুশাকৃতির সমাধি মন্দির বর্গাকার ভিতের উপর নিরেট স্তূপ হিসেবে নির্মাণ করা হয়। প্রথম পর্যায়ের অর্থাৎ প্রাচীনতম স্থাপত্যিক কাঠামোর নির্মাণকাল খ্রিস্টীয় ছয় থেকে সাত শতকের বলে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ অনুমান করেন।
পরবর্তীকালে দ্বিতীয় পর্যায়ে (অর্থাৎ খ্রিস্টীয় আট শতকে) এটিকে একটি প্রায় ক্রুশাকৃতির সমাধিমন্দিরে রূপান্তরিত করা হয়। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত এ প্রত্নস্থানের তৃতীয় পর্যায়ের অর্থাৎ সর্বশেষ নির্মাণকালের স্থাপত্যিক কাঠামোর ধ্বংসাবশেষের সামান্য কিছু বর্তমানে অবশিষ্ট রয়েছে। সর্বশেষ স্থাপত্যিক কাঠামোটির নির্মাণকাল খ্রিস্টীয় দশ থেকে এগারো শতকের বলে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ অনুমান করেন।
বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থাপত্যিক কাঠামো নির্মাণের ফলে এখানে এমন সব বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে, যা অন্য প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির ও বিহারে লক্ষ্য করা যায় না। ক্রুশাকৃতির মন্দিরের প্রতিটি লম্বা বাহুতে একটি ভজনালয়সহ পূর্ব (অর্থাৎ সামনের দিকে) ভাগে লম্বা এবং সরু ভজনালয় নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে কুমিল্লার ময়নামতি জাদুঘরে প্রদর্শিত পাথরের বিশাল বুদ্ধ মূর্তিটি মাঝের ভজনালয়ে পাওয়া গিয়েছিল বলে জানা যায়। এখানকার অন্যান্য ভজনালয়ে কয়েকটি ব্রোঞ্জ মূর্তি পাওয়া যায়।
রূপবান মুড়া মন্দিরটি থেকে ৩০ মিটার দক্ষিণ-পূর্বে কোণে আলাদাভাবে বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করা হয়। বর্গাকৃতির ছোট এ বিহারটির প্রতিটি বাহুর পরিমাপ ৩৪ মিটার। বিহারটির সামনে একটি প্রবেশপথ কমপ্লেক্স রয়েছে। প্রবেশপথটি বিহারের উত্তর বাহুর মাঝখানে বাহিরের দিকে প্রক্ষিপ্ত। প্রচলিত বর্গাকৃতি পরিকল্পনায় নির্মিত এ বিহারের চার দিকেই আদিতে মোট চব্বিশটি কক্ষ ছিল।
তবে পরবর্তীকালে দ্বিতীয় পর্যায়ে তা আঠারোটিতে হ্রাস করা হয়েছে বলে জানা যায়। বিহারের ১২ মিটার আয়তনের দক্ষিণাংশ পরিত্যক্ত হয়, কারণ এটি তখন মেরামতের অযোগ্য ছিল। সামনের দিকে এক সারি নতুন কক্ষ নির্মাণ করা হলে বিহারটির আয়তাকার রূপ ধারণ করে। তখন এটির দৈর্ঘ্য ৩৪ মিটার এবং প্রস্থ ২২ মিটার হয়। দ্বিতীয় পর্বে নির্মিত বিহারের কক্ষগুলোতে কর্বেলকৃত কুলুঙ্গি এবং ইটের তৈরি ফ্রেম দেখা যায়। পানি নিষ্কাশনের জন্য বিহার অঙ্গনে একটি কর্বেলকৃত নালা তৈরি করা হয়েছিল।
পাথরের বিশাল বুদ্ধমূর্তি ছাড়াও রূপবান মুড়া প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনসমূহের মধ্যে খড়গ বংশীয় রাজা বলভট্টের খাদ মিশ্রিত পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা ছিল বলে জানা যায়। [মো: শাহীন আলম]
তথ্যসূত্র :
১. রশীদ, এম হারুনুর, রূপবান মুড়া;
২. The Lalmai – Mainamati Group of monuments;
৩. প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ।
Follow Us in Our YouTube channel: GEONATCUL