ইতিহাসের নীরব সাক্ষী: লক্ষ্মীপুরের দালাল বাজার জমিদার বাড়ির অজানা গল্প
দালাল বাজার জমিদার বাড়ি, [ভিডিও লিংক] বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জেলা লক্ষ্মীপুরের একটি ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। ক্ষতবিক্ষত চেহারা নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে থাকা এই ধ্বংসাবশেষ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় একটি গৌরবময় অতীতকে। প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এ জমিদার বাড়ি কমপ্লেক্সে রয়েছে—
-
আঠারো-উনিশ শতকে নির্মিত জমিদার প্রাসাদ;
-
অন্দরমহল ও নৃত্যশালা;
-
অন্দর পুকুর ও শানবাঁধানো ঘাট; এবং
-
সীমানা প্রাচীর ও বৃক্ষশোভিত বহিরাঙ্গণ।
এই নিদর্শনগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
📖 ইতিহাসের পাতা থেকে
তথ্যসূত্র মতে, আঠারো শতকে লক্ষ্মী নারায়ণ বৈষ্ণব নামে একজন ব্যবসায়ী ভারতের কলকাতা থেকে দালাল বাজারে এসে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। পরে তাঁর পুত্র ব্রজবল্লভ সেই ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত করেন। এরপর ব্রজবল্লভের পুত্র গৌরকিশোর কলকাতায় লেখাপড়া করার সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং জমিদারি লাভ করেন। ১৭৬৫ সালে তিনি ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত হন।
গৌরকিশোর ও রানি লক্ষ্মীপ্রিয়ার কোনো সন্তান না থাকায় তারা ঢাকার বিক্রমপুর থেকে গোবিন্দ কিশোর নামে এক পুত্রকে দত্তক নেন। পরে গোবিন্দ কিশোর ও তার পুত্র নলীনি কিশোর এই জমিদারির পরিচালনায় যুক্ত হন।
জমিদারদেরই দানকৃত প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে রয়েছে:
-
এন. কে. উচ্চ বিদ্যালয়;
-
ঠাকুর মন্দির;
-
দাতব্য চিকিৎসালয়; এবং
-
এবং জমিদারবাড়ির পূর্বদিকে অবস্থিত বিশাল খোয়া সাগর দিঘি।
🧭 ‘দালাল বাজার’ নামকরণের জনশ্রুতি
জনশ্রুতি অনুযায়ী, জমিদার পরিবার ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক এজেন্ট হিসেবে কাজ করত। স্থানীয় জনগণ তাঁদের ‘দালাল’ বলে আখ্যায়িত করে, এবং সেই থেকে স্থানটির নাম হয়ে যায় দালাল বাজার।
📅 জমিদার পরিবারের শেষ অধ্যায়
১৯৪৬ সালের নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর দাঙ্গা চলাকালে জমিদার পরিবার এ বাড়ি ত্যাগ করে চলে যায়। এরপর থেকেই জমিদারির পরিসমাপ্তি ঘটে এবং বাড়িটি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
🧱 স্থাপত্যশৈলী
বর্তমানে বাড়িটিতে দেখা যায় —
-
ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যধর্মী ধ্বংসাবশেষ;
-
চুন-সুরকি, পোড়ামাটির ইট, চিনি টিকরি ও লোহার বিম;
-
দেয়ালে খোদাই করা ফুল-লতা পাতার অলঙ্করণ;
-
ডোরিক, আয়নিক ও করিন্থিয়ান ঘরানার কলাম; এবং
-
অর্ধবৃত্তাকার, সেগমেন্টাল ও সমতল খিলান।
তবে অধিকাংশ স্থাপনার ছাদ ধসে গেছে এবং জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
🗺️ অবস্থান
লক্ষ্মীপুর জেলার সদর চৌমাথা থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার পশ্চিমে বাসস্টেশন, এরপর বাসস্টেশন থেকে উত্তর দিকে ২.৫ কিলোমিটার গেলে খোয়া সাগর দিঘি, আর সেখান থেকে আরও ৫০০ মিটার অগ্রসর হলে বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে দালাল বাজার জমিদার বাড়ি।
🏛️ সংরক্ষণ ও সম্ভাবনা
২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেট অনুযায়ী, এটি সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি এবং বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। স্থাপত্য, ইতিহাস ও পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় এই ঐতিহ্যবাহী স্থানটির দ্রুত সংস্কার ও উন্নয়নমূলক উদ্যোগ প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে এ বাড়িটির সংস্কার ও উন্নয়নমূলক কাজে ইতিবাচক মনোভার দেখিয়েছে বলে জানা যায়।
✍️ লেখক: মো. শাহীন আলম
📜 তথ্যসূত্র:
১। দালাল বাজার জমিদার বাড়ী, lakshmipur.gov.bd;
২। যে জমিদারবাড়ির ইটে ইটে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, prothomalo.com;
৩। নোয়াখালী দাঙ্গা, wikipedia.org;
৪। দালাল বাজার জমিদার বাড়ি, vromonguide.com;
৫। লেখকের সরেজমিন পরিদর্শনকালীন তথ্য-উপাত্ত ও আলোকচিত্র;
৬। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চল, কুমিল্লা।