শালবন বিহার: লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে লুকানো ইতিহাস, ধর্ম ও স্থাপত্যের এক বিস্ময়কর সমাহার
শালবন বিহার [Video] — প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার এক বিস্ময়কর সমাহার ও বাংলার এক নিস্তব্ধ সাক্ষী। কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ে অবস্থিত এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি ৭ম থেকে ৮ম শতাব্দীর এক সমৃদ্ধ বিহারকে ধারণ করে। শ্রী ভবদেব মহাবিহার নামে পরিচিত এ বিহার দেব বংশের রাজা শ্রী ভবদেবের অনুগ্রহে নির্মিত। ১৬৮ মিটার দৈর্ঘ্যের চতুর্ভুজাকার, ১১৫টি ভিক্ষু কক্ষ এবং বিশাল কেন্দ্রীয় মন্দির নিয়ে গঠিত এ বিহার প্রাচীন বাংলার স্থাপত্যশৈলীর উৎকর্ষ প্রকাশ করে। আজও এর ধ্বংসাবশেষ, প্রত্নবস্তু ও স্থাপত্যের নিদর্শন বৌদ্ধ বিশ্বাস, শিল্প ও হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার গল্প ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে।
📍 শালবন বিহারের অবস্থান
শালবন বিহার বাংলাদেশে কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলাধীন শালমানপুর গ্রামে, কোটবাড়ি থেকে দক্ষিণদিকে প্রায় ১.৫ কিলোমিটার দূরে, অবস্থিত। সবুজ-আচ্ছাদিত লালমাই পাহাড়ের কোলে বিস্তৃত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি প্রাচীন বৌদ্ধ বাংলার স্থাপত্য ও আধ্যাত্মিকতার এক অনবদ্য নিদর্শন। এখানে পা রাখলেই প্রায় ১,৩০০ বছর আগে গড়ে উঠা একটি ঐতিহ্যের সন্ধান পাবেন।
🛕 শ্রী ভবদেব মহাবিহার: প্রাচীন নামের রহস্য উন্মোচন
আজকের শালবন বিহার পূর্বে শ্রী ভবদেব মহাবিহার নামে পরিচিত ছিল। ৭ম থেকে ৮ম শতাব্দীতে দেব বংশের চতুর্থ শাসক রাজা শ্রী ভবদেব এ মহাবিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি শুধু একটি বিহারই ছিল না, বরং তখনকার সময়ের বৌদ্ধ সভ্যতার একটি ধর্মীয় ও শিক্ষামূলক কেন্দ্র ছিল।

🧱 স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠত্ব: আধ্যাত্মিক জীবনের পূর্ণ ক্ষেত্র
একটি বিশাল বর্গাকৃতির বিহার, যার প্রতিটি বাহু ১৬৮ মিটার দীর্ঘ, আর ভিতরে রয়েছে ভিক্ষুদের জন্য ১১৫টি কক্ষ — এটাই হলো শালবন বিহার। এর কেন্দ্রস্থলে একটি প্রধান মন্দির, যাকে ঘিরে রয়েছে ছোট ছোট মন্দির ও স্তুপ। উত্তর দিকের দৃশ্যমান তোরণের ধ্বংসাবশেষটি বৌদ্ধ ধর্মীয় আনুষ্ঠানিক পথ ও উন্মুক্ত উপাসনার একটি পবিত্র স্থানের ইঙ্গিত দেয়। এছাড়াও রয়েছে –
-
সন্ন্যাস কক্ষে অলংকৃত ইটের পাদস্তম্ভ ও আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা এবং কুলঙ্গি; এবং
-
দরবার আঙ্গিনা ও সোপান।

🕰️ ঐতিহাসিক যাত্রা: নির্মাণ ও সংস্কারের পর্যায়সমূহ
প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধানকালে বিহারটির নির্মাণ ও পুন:নির্মাণের প্রধান কয়েকটি ধাপ খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলো হলো:
- ৩য় পর্যায় (৭ম-৮ম শতাব্দী): সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির, ক্রুশাকৃতির নকশায় নির্মিত;
- ৪র্থ ও ৫ম পর্যায় (৯ম-১০ম শতাব্দী): আয়তাকার কাঠামো, অধিকতর খোলা এবং হিন্দু মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর ছাপ; এবং
- ১ম ও ২য় পর্যায় (৭ম শতাব্দীর আগে): এ পর্যায়ের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
🔥 বিহার জীবন – ভিক্ষুকক্ষে আচরণবিধির ছাপ
ভিক্ষুদের কক্ষগুলোতে এখনও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এগুলো হলো:
-
আগুন প্রজ্বলনের জন্য নির্মিত সজ্জিত ইটের চৌকি/স্তম্ভমূল; এবং
-
সিঁড়ি, মূর্তি রাখার নিভৃতি কোটর এবং প্রাঙ্গণের সিঁড়ি, যা তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক প্রতীকতাকে প্রকাশ করে।
🛕 একটি নয়, ছয়টি মন্দির: কেন্দ্রীয় মন্দিরের ক্রমবিবর্তন
কেন্দ্রীয় মন্দিরটি একক কোনো স্থাপনা নয়; এখানে পর্যায়ক্রমে ছয়টি ভিন্ন নির্মাণ কাঠামো একই স্থানে একের পর এক তৈরি করা হয়েছিল। এ কাঠামোগত স্তরগুলো ধর্মীয় ও সামাজিক পরিবর্তনের সাথে স্থাপত্যের ক্রম বিবর্তনকে প্রকাশ করে।
🧱 মৃৎশিল্প: পোড়ামাটির ঐশ্বর্য
প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত প্রচুর মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির চিত্রফলক, মন্দিরের বাহির দেয়ালগুলোর পোড়ামাটির প্যানেল, অলঙ্কৃত ইট এবং নকশাদার স্তম্ভগুলোর মাধ্যমে শালবন বিহারের উন্নত শিল্পকলার পরিচয় পাওয়া যায়। এসব বৈশিষ্ট্য এ বিহারকে নালন্দা ও বিক্রমশিলার মতো বিখ্যাত বৌদ্ধ কেন্দ্রের সাথে সংযোগ স্থাপন করে।
🏺 বিহার নয়, যেন এক প্রাচীন নগরবসতি
প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় নিম্নলিখিত নিদর্শনগুলোও খুঁজে পাওয়া যায়:
-
বিশাল বিহারের অভ্যন্তরে জলকূপ ও পাকা আঙিনা;
-
ভোজনালয়, প্রার্থনা কক্ষ বা ছোট-বড় মন্দির ও ছোট-বড় স্তুপ; এবং
-
প্রচুর মুদ্রা, মৃৎপাত্র, সিলমোহর, তাম্রলিপি, মূর্তি ও অলংকৃত ইটের মতো মূল্যবান প্রত্নবস্তু।
এসব প্রত্নতাত্ত্বিক আলামত প্রমাণ দেয় যে, শালবন বিহার ছিল একটি বৃহৎ প্রাচীন ধর্মীয় ও নগর বসতির কেন্দ্র।
🏛️ প্রত্নবস্তু সংরক্ষণ: ময়নামতি জাদুঘর
শালবন বিহার ও আশেপাশের প্রত্নস্থান থেকে পাওয়া বহু প্রত্নবস্তু বর্তমানে ময়নামতি জাদুঘরে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত রয়েছে। এসব সংগ্রহ প্রাচীন সমতট এবং দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার বৌদ্ধ যুগের গল্প বলে, যা খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত।
🌿 প্রাচীন বাংলার এক জীবন্ত প্রতিধ্বনি
শালবন বিহার শুধু ধ্বংসাবশেষ নয়, এটি প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ বিদ্যা, শিল্প ও ভক্তির এক জীবন্ত স্মৃতি। বিহারের মধ্যে হেঁটে বেড়ালে আপনি শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান দেখবেন না, বরং একটি হারানো সভ্যতার সাথে নিজের সংযোগ স্থাপন করবেন।
📜 সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
শালবন বিহারকে The Ancient Monuments Preservation Act, 1904 অনুযায়ী ১৯৪৫ সালের ৭ জুলাই ‘Shalban Raja’s Palace’ নামে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি স্বীকৃত প্রত্নস্থানে পরিণত হয় এবং বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদায় পৌঁছাতে ১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি, শালবন বিহার “The Lalmai-Mainamati Group of Monuments” শিরোনামে ইউনেস্কোর সম্ভাব্য বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সম্ভাব্য তালিকায় (Tentative List) অন্তর্ভুক্ত হয়। এ তালিকাভুক্তি মূলত শালবন বিহারসহ আশেপাশের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর সম্মিলিত ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যিক গুরুত্বকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথে নিয়ে যায়।
✍️ লেখক: মো. শাহীন আলম
তথ্যসূত্র :
১. রশীদ, এম হারুনুর, শালবন বিহার ;
২. শালবন বিহার (ফোল্ডার), প্রকাশ: জুন ২০২২, আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ, কুমিল্লা;
৩. প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ২০১০-২০১১, শালবন বিহার, কুমিল্লা, প্রত্নচর্চা-৬, জুন ২০১৫ পৃষ্ঠা ২১ – ২৬;
৪. The Lalmai-Mainamati Group of monuments;
৫. প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ।
Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL
ওয়েগনারের মহাদেশ সঞ্চালন তত্ত্ব