সাভানা বায়োম | Savanna Biome
সাভানা বায়োম (Savanna Biome) বলতে সাধারণত ক্রান্তীয় আর্দ্র ও শুষ্ক জলবায়ুকে বুঝায় (কোপেনের Aw জলবায়ু)। আবার, উদ্ভিদবিজ্ঞানীগণ সাভানা বলতে ক্রান্তীয় অঞ্চলের বিশেষ ধরনের ঘাসের প্রাধান্যবিশিষ্ট উদ্ভিদ সম্প্রদায়কে বুঝান। প্রকৃতপক্ষে, সাভানা হলো ক্রান্তীয় অঞ্চলের এক ধরনের তৃণভূমি, যেখানে বিক্ষিপ্তভাবে গুল্ম ও বৃক্ষ প্রজাতির উদ্ভিদ জন্মায় এবং ছড়ানো অবস্থায় থাকে।

সাভানা বায়োম অবস্থান:
পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের ১০০ থেকে ২০০ অক্ষাংশের মধ্যে সাভানা বায়োম বা সাভানা জীবভূমি অবস্থিত। সাধারণত মহাদেশসমূহের অভ্যন্তরে মরু উদ্ভিদের চারদিকে স্বল্প বৃষ্টিপাতবিশিষ্ট শুষ্ক অঞ্চলে সাভানা বায়োম দেখা যায়। পৃথিবীর প্রধান প্রধান সাভানা বায়োমসমূহ দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান অরণ্যের উত্তরাংশে (কলম্বিয়া ও ভেনিজুয়েলার অরিনকো উপত্যকায়); দক্ষিণ কেন্দ্রীয় ব্রাজিল, গায়েনা, প্যারাগুয়ে; উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে; সুদানসহ আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকার উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলে; মাদাগাস্কার; এবং অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাংশে অবস্থিত।

সাভানা বায়োমের বৈশিষ্ট্য:
(১) সাভানা বায়োম অঞ্চলে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতু প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
(২) এ বায়োম অঞ্চলে শীতকাল বৃষ্টিহীন, গ্রীষ্মকালে সীমিত পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়।
(৩) এ বায়োম অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আনুমানিক ১০ ইঞ্চি থেকে ৪০ ইঞ্চি।
(৪) গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের যে সব স্থানে বছরে ৪০ ইঞ্চি থেকে ৬০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে ‘সাভানা’ নামক তৃণভূমি দেখা যায়।
(৫) এ অঞ্চলে জোয়ার, বাজরা, গম, প্রভৃতি ফসলের চাষাবাদ হয়।
(৬) এ বায়োমে সাধারণত বৃষ্টিপাত কম হয়ে থাকে এবং বছরে একটানা বহুদিন ধরে আবহাওয়া শুষ্ক অবস্থায় থাকে।
(৭) শুষ্ক আবহাওয়ার জন্য সাভানা বায়োম অঞ্চলে তৃণভূমি শুকিয়ে যায়। এর ফলে মাঝে মাঝে এ অঞ্চলে আগুন ধরে যায়।
(৮) আফ্রিকা মহাদেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আয়তনের সাভানা বায়োম অবস্থিত। তবে এ ধরনের বায়োমের তৃণভূমি দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায়ও রয়েছে।
সাভানা বায়োমের জলবায়ু:
সাভানা বায়োম অঞ্চলে জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আর্দ্র ও শুষ্ক ঋতু বিরাজ করে। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত নিরক্ষরেখার প্রান্তে ১৩০ সেন্টিমিটার থেকে ২০০ সেন্টিমিটার। যা মরু প্রান্তে ২৫ সেন্টিমিটার থেকে ৫০ সেন্টিমিটারের মধ্যে হয়ে থাকে। এ বায়োম অঞ্চলে শীতল শুষ্ক ঋতুর বৈশিষ্ট্য হলো দিনের বেলায় তাপমাত্রা ২৬° থেকে ৩২° সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। তবে রাতের তাপমাত্রা ২১° সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়। অপরদিকে উষ্ণ শুষ্ক ঋতুতে দিন ও রাতের তাপমাত্রা ৩২° থেকে ৩৮° সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। উষ্ণ আর্দ্র ঋতুতে বছরের মোট বৃষ্টিপাতের প্রায় ৮০% থেকে ৯০% লাভ করে থাকে।
সাভানা বায়োমের উদ্ভিদ:
সাভানা বায়োম অঞ্চলে স্বল্প স্থায়ী আর্দ্র ঋতু এবং দীর্ঘ শুষ্ক ঋতুর কারণে উদ্ভিদ সম্প্রদায়ের মধ্যে তৃণ জাতীয় উদ্ভিদের প্রধান্য বেশি দেখা যায়। এ বায়োমের উদ্ভিদসমূহকে উচ্চতার ভিত্তিতে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো:
(ক) ভূমি সংলগ্ন স্তরের উদ্ভিদ: সাভানা বায়োমের ভূমি সংলগ্ন এ স্তরে বিভিন্ন ধরনের ঘাস ও তৃণ জাতীয় উদ্ভিদের প্রাধান্য বেশি থাকে। সাভানার তৃণসমূহ সাধারণত মোটা, শক্ত ও কঠিন হয়ে থাকে। বছরব্যাপী জীবনকালের এসব তৃণের উচ্চতা ৮০ সেন্টিমিটার। তবে এ স্তরের কোনো কোনো তৃণ প্রজাতির উচ্চতা ৩.৫ মিটারেরও বেশি হয়ে থাকে। শুষ্ক ঋতুতে এখানকার ঘাসগুলো বিবর্ণ হয়ে যায়। তবে আর্দ্র ঋতুতে ঘাসগুলো নতুন পাতা গঁজিয়ে সবুজ হয়ে উঠে।
(খ) মধ্য স্তরের উদ্ভিদ: সাভানা বায়োমের মধ্য স্তরে কাঁটা জাতীয় এবং গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ বেশি দেখা যায়। শুষ্ক ঋতুর প্রাধান্যের কারণে এ স্তরের উদ্ভিদের পাতাসমূহ পূর্ণ বিকশিত নয়। ফলে এ উদ্ভিদসমূহ কাঁটা জাতীয় বনে পরিণত হয়।
(গ) সর্বোচ্চ স্তরের উদ্ভিদ: সাভানা বায়োমের বৃক্ষরাজি সাধারণত ১২.৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। বায়োমের শুষ্ক অবস্থার কারণে বৃক্ষগুলোতে বিভিন্ন ধরনের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠে। শুষ্ক ঋতুতে ভূ-গর্ভস্থ পানির সন্ধানে সাভানা বৃক্ষ প্রজাতির মূলগুলো মাটির অনেক গভীরে প্রবেশ করে। এ বায়োমের বৃক্ষগুলোর মধ্যে শিমুল, বাবলা, শ্যাওড়া, তালজাতীয় বৃক্ষ, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

P.A. Furley and W.W, Newey কর্তৃক প্রদত্ত সাভানা বায়োমের শ্রেণি বিভাগে: বৃক্ষ এবং তৃণভূমির অনুপাত এবং উদ্ভিদের গঠনের উপর ভিত্তি করে P.A. Furley and W.W, Newey, ১৯৮৩ সালে সাভানা বায়োমকে চারটি ভাগে ভাগ করেন। এগুলো হলো:
(ক) কাষ্টল সাভানা (Woodland Savanna): সাভানা বায়োম অঞ্চলে নদী সংলগ্ন আর্দ্র স্থানে বৃক্ষ প্রজাতির সংখ্যা ও ঘনত্ব তুলনামূলক বেশি থাকে। বৃক্ষ ও গুল্ম প্রজাতির উদ্ভিদগুলোর উপরিভাগ পরস্পরের নিকটে থেকে ছাউনি (kiosk) সৃষ্টি করে।
(খ) বৃক্ষ সাভানা (Tree Savanna): সাভানা বায়োম অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ছিটানো বৃক্ষ ও গুল্ম প্রজাতির উদ্ভিদের আবরণবিশিষ্ট স্থানকে বৃক্ষ সাভানা বলা হয়। এখানকার মাটি সাধারণত তৃণ দিয়ে আবৃত এবং বৃক্ষগুলো কোনো প্রকারের ছাউনি (kiosk) সৃষ্টি করে না।
(গ) গুল্ম সাভানা (Shurb Savanna): সাভানা বায়োম অঞ্চলে কোনো কোনো স্থানের মাটি সাধারণত তৃণ দিয়ে আবৃত। এসব স্থানে কোনো বৃক্ষ দেখা যায় না এবং বিক্ষিপ্ত গুল্ম প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা যায়। এরূপ বায়োমকে গুল্ম সাভানা বলে। বৃষ্টিপাত তুলনামূলক কম হয়ে থাকে, মাঝে মাঝে চরম শুষ্কতা বিরাজ করে, এরূপ অঞ্চলে গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ বেশি দেখা যায়। গুল্ম সাভানার উদ্ভিদগুলোর সাথে মরু উদ্ভিদের প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে।
(ঘ) তৃণ সাভানা (Grass Savanna): সাভানা বায়োম অঞ্চলে কোনো কোনো স্থানের মাটিতে বৃক্ষ ও গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ অনুপস্থিত। এসব স্থানের মাটিতে তৃণের আচ্ছাদনও নিরবিচ্ছিন্ন নয়। আর, এরূপ উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সাভানাকেই তৃণ সাভানা বলে।

সাভানা বায়োমের প্রাণী:
আফ্রিকা মহাদেশের সাভানা বায়োম অঞ্চল সর্বাধিক সংখ্যক বৈচিত্র্যময় তৃণভোজী স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। দক্ষিণ আফ্রিকার সাভানা বায়োম অঞ্চলে হরিণ, মহিষ, জেব্রা, হাতি, জলহস্তি, প্রভৃতিসহ ৪০ প্রজাতির বৃহৎ আকৃতির তৃণভোজী স্তন্যপায়ী প্রাণী বসবাস করে। এসব প্রজাতিগুলোর মধ্যে ১৬টি একই আবাসস্থলে একসাথে বিচরণ করে। দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার সাভানা বায়োম অঞ্চলে বেশি সংখ্যক বৈচিত্র্যময় স্তন্যপায়ী প্রাণী নেই। তবে সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বসবাস করে, যা আফ্রিকান সাভানায় দেখা যায় না। অস্ট্রেলিয়ার সাভানা বায়োম অঞ্চল থলেবিশিষ্ট স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্য বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। অস্ট্রেলিয়ার সাভানায় আনুমানিক ৫০ প্রজাতির ক্যাঙ্গারু রয়েছে। [মো: শাহীন আলম]
সহায়িকা:
১। Singh, Savindra, (2009), Physical Geography, Allahabad: Prayag Pustak Bhawan, Page 609 – 614.
২। রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, (২০১৭ – ২০১৮), প্রাকৃতিক ভূগোল, ঢাকা: কবির পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ৬০৫ – ৬০৭।
৩। Savanna, ecological region, britannica.com
সাভানা বায়োম কোথায় অবস্থিত?
Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL