সিলেট অঞ্চলের ইতিহাস : এক গবেষণাধর্মী পর্যালোচনা

সিলেট, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সীমান্তবর্তী একটি অঞ্চল। অঞ্চলটি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে এক প্রাচীন ও স্বতন্ত্র ভূখণ্ড। প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন থেকে শুরু করে কামরূপ, বিক্রমপুর ও সুলতানি শাসনের ধারায় এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সুস্পষ্ট। মধ্যযুগে ইসলাম আগমন এবং মোগল শাসনের প্রভাবে সিলেটে নতুন সামাজিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর উদ্ভব ঘটে। ব্রিটিশ আমলে সিলেটকে আসাম প্রদেশের সাথে যুক্ত করা হয়, পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের গণভোটে এটি পূর্ববঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। সামগ্রিকভাবে, সিলেটের ইতিহাস এক ধারাবাহিক পরিবর্তনের দলিল, যা বাংলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক অভিযাত্রাকে প্রতিফলিত করে। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত সিলেট অঞ্চলের ইতিহাস নিম্নে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হলো। 

১. প্রাচীন যুগ (সপ্তম – একাদশ শতাব্দী) :

সিলেট অঞ্চলের ইতিহাসের সূচনা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের গবেষক জয়ন্ত সিংহ এবং তাঁর সহকর্মীরা হবিগঞ্জ জেলার চাকলাপুঞ্জি গ্রামে প্রাগৈতিহাসিক পাথরের ছেঁটে তৈরি হাতিয়ার (tools) আবিষ্কার করেন (Jayanta Singh et al., A Study of Prehistoric Tools from Chaklapunji, Journal of the Dept. of Archaeology, Jahangirnagar University, Vol. 6, June 2000)। এ আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, সিলেটের ভূভাগে প্রাগৈতিহাসিক মানব সমাজের বসতি ছিল।

সপ্তম শতাব্দীতে (7th Cen CE) সিলেট অঞ্চল কামরূপ (বা প্রাগজ্যোতিষ) রাজ্যের অধীনে ছিল। এ সময়ের প্রমাণ পাওয়া যায় নিধনপুর তাম্রলিপি থেকে। নিধনপুর বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত বলে জানা যায়। এতে রাজা ভাস্করবর্মার নাম উল্লেখ আছে, যিনি আনুমানিক ৬০০–৬৫০ অবধি কামরূপের শাসক ছিলেন (সূত্র: সুনীতিভূষণ কানুনগো, প্রাচীন শ্রীহট্ট, সিলেট ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, ১৯৯৯, পৃ. ১৩৯)।

পরবর্তীকালে, মৌলভীবাজারের কালাপুর এলাকায় আরেকটি তাম্রলিপি পাওয়া যায়, যা সপ্তম শতাব্দীর শেষ দিকের। সেখানে রাজা নারায়ণ ভক্ত সামন্ত মরুগুণাথ ভট্টারক-এর জমিদান সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায়। এসব দলিল থেকে বোঝা যায় যে, তখনকার সিলেট অঞ্চল পাহাড়ি ও উপপাহাড়ি অঞ্চলসহ বৃহত্তর কামরূপ রাজ্যের একটি প্রশাসনিক অংশ ছিল।

দশম শতাব্দীতে বিক্রমপুরের চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্র (৯২৯–৯৭৫ অব্দ) ‘চন্দ্রপুর মণ্ডল’ নামে এক প্রশাসনিক ইউনিট গঠন করেন, যেখানে প্রথমবারের মতো ‘শ্রীহট্ট’ নাম উৎকীর্ণ অবস্থায় পাওয়া যায় (সূত্র: কানুনগো, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪০)। এ সময় থেকেই শ্রীহট্ট একটি স্বতন্ত্র মণ্ডল বা উপ-প্রদেশে পরিণত হয়।

অতএব, প্রাচীন যুগের শেষ পর্যায়ে সিলেট অঞ্চল ছিল কামরূপবিক্রমপুর রাজ্য — এ দুই ধারার রাজনৈতিক প্রভাবের অধীনে এক সাংস্কৃতিক সংযোগস্থল।

২. মধ্যযুগ (দ্বাদশ – অষ্টাদশ শতাব্দী) :

২.ক. শ্রীহট্ট রাজ্যের বিকাশ: একাদশ শতাব্দীতে ‘শ্রীহট্ট রাজ্য’ নামে এক ক্ষুদ্র স্থানীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। গবেষক কে. কে. গুপ্ত ও কানুনগো (Journal of the Varendra Research Museum, Vol. VI, 1975–76, p.11) উল্লেখ করেছেন যে, এ সময়কার তাম্রলিপিগুলোর ধরণ থেকে বোঝা যায়, রাজা ও সামন্তগণ নিজেদের স্বাধীন শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

২.খ. ইসলাম আগমন ও সুলতানি প্রভাব: সুলতানি আমলে গৌড়ের সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৩০১–১৩২২ অব্দ)-এর সেনাপতি সিকান্দর খান গাজী ১৩০৩ অব্দ রাজা গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করে সিলেট জয় করেন। এ বিজয়ই সিলেটে ইসলামী (বা মুসলিম) শাসনের সূচনা নির্দেশ করে। এ সময়েই হজরত শাহজালাল (রহ.) ও তাঁর ৩৬০ অনুসারী সিলেটে আগমন করে সুফি-ইসলামী সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন করেন (সূত্র: সিলেট দরগাহ শরিফের শিলালিপি, ১৪৭২, ১৫০৫ ও ১৫১২ সাল)।

২.গ. ক্ষুদ্র রাজ্যসমূহ ও স্থানীয় শাসন: চৌদ্দ শতাব্দীতে সিলেট বিভক্ত হয় একাধিক ক্ষুদ্র রাজ্যে। যেমন: শ্রীহট্ট বা সিলেট সদর: রাজা গৌর গোবিন্দ, তরফ বা বরহ্মচল অঞ্চল: রাজা আচক নারায়ণ, লাউর রাজ্য: রাজা লুদ্দক, জৈন্তিয়া রাজ্য: বড় গোসাই উমিশ্বরী, এবং ইটা রাজ্য: নিধিপতি শাস্ত্রএ রাজ্যগুলোর প্রত্যেকটি নিজস্ব প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বজায় রাখত।

২.ঘ. মোগল শাসন: আইন-ই আকবরি-তে দেখা যায় যে, মোগলগণ সিলেটকে ‘সরকার-ই-শ্রীহট্ট’ নামে একটি প্রশাসনিক ইউনিট ঘোষণা করেন, যার অধীনে ছিল তরফ, লাউর, বাজু, সরাইল, জৈন্তিয়া, প্রভৃতি পরগনা (সূত্র: East Pakistan District Gazetteers: Sylhet, 1970, p. 58)। তবে স্থানীয় রাজাগণ অনেকাংশেই স্বাধীনতা বজায় রেখেছিলেন।

জৈন্তিয়া রাজা, যেমন: ধনমাণিক (১৫৯৬–১৬০৬ অব্দ), যশোমাণিক (১৬০৬–৪১), প্রমুখ — কোচ, কাছাড় ও আহোম রাজ্যের সাথে সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়েও মোগলদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখেন।

৩. আধুনিক যুগ (অষ্টাদশ শতাব্দী – বর্তমানকাল):

৩.ক. নবাব ও কোম্পানি আমল: প্রথম নবাব মুশরিকুল খাঁ সিলেটকে ‘চাকলা শ্রীহট্ট’ হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৭৬৫ অব্দে দিল্লির মোগল সম্রাটের কাছ থেকে দেওয়ানি অধিকার (রাজস্ব আদায়) লাভ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কার্যত সিলেটের শাসনভার গ্রহণ করে। ১৭৯৯ অব্দে প্রথম কালেক্টর নিয়োগ হয় এবং প্রশাসন পূর্ণ ব্রিটিশ কাঠামোয় রূপ নেয়।

৩.খ. আসাম প্রদেশে সংযুক্তি: ১৮৭৪ সালে সিলেট অঞ্চলকে তৎকালীন আসাম প্রদেশের অধীনে সংযুক্ত করা হয়। এ সময় থেকে সিলেট বাঙালি মুসলমান ও আসামি সংস্কৃতির এক মিলনস্থলে পরিণত হয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গেও সিলেট আসামের অন্তর্ভুক্ত থাকে।

৩.গ. দেশবিভাগ ও গণভোট: ১৯৪৭ সালের গণভোটে সিলেটের অধিকাংশ জনগণ পূর্ববঙ্গ (বাংলাদেশ)-এর সাথে যুক্ত থাকার পক্ষে ভোট দেন, ফলে সিলেট বাংলাদেশের অন্তর্গত হয়। এভাবেই সিলেটের দীর্ঘ প্রাগৈতিহাসিক – সুলতানি – ঔপনিবেশিক ইতিহাস এক নতুন জাতীয় সীমানায় সমাপ্তি লাভ করে।

সিলেটের ইতিহাস প্রমাণ করে, এটি এক বহুস্তরীয় সাংস্কৃতিক অঞ্চল — যেখানে কামরূপের রাজনীতি, বিক্রমপুরের বৌদ্ধ-হিন্দু ঐতিহ্য, ইসলামি সুফিবাদ এবং ঔপনিবেশিক প্রশাসন ধারাবাহিকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন থেকে ব্রিটিশ প্রশাসন পর্যন্ত প্রতিটি পর্বে সিলেট ছিল বাঙলা ও আসামের সংযোগপথে এক অনন্য ঐতিহাসিক সংমিশ্রণভূমি।


📚 সহায়িকা:
১. Jayanta Singh et al., A Study of Prehistoric Tools from Chaklapunji, Hobigonj, Journal of the Dept. of Archaeology, Jahangirnagar University, Vol. 6, June 2000.
২. সুনীতিভূষণ কানুনগো, প্রাচীন শ্রীহট্ট, সিলেট ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, ১৯৯৯।
৩. K. K. Gupta, Journal of the Varendra Research Museum, Vol. VI, 1975–76.
৪. S. N. H. Rizvi (Gen. ed.), East Pakistan District Gazetteers: Sylhet, Dacca, 1970.
৫. মোহা. মোসাররফ হোসেন, বেড়াই দেশের মাটি (সিলেট বিভাগ), অক্ষর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২৩।


✍️ লেখক: মো. শাহীন আলম


Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL


Leave a Reply