সিলেট নামকরণের ইতিহাস: প্রাচীন নাম থেকে আধুনিক পরিচয়ের যাত্রা
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত সিলেট শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেই নয়, ইতিহাস ও সংস্কৃতির গৌরবেও ভরপুর। তবে এ “সিলেট” (sylhet) নামের পেছনের গল্পটি অনেক প্রাচীন ও আকর্ষণীয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নামটি রূপান্তরিত হয়ে আজকের পরিচয়ে পৌঁছেছে।

সিলেট (sylhet) প্রাচীন নাম ও উৎস:
প্রখ্যাত চৈনিক ভ্রমণকারী হিউয়েন সাঙ (hiuen tsang) সপ্তম শতাব্দীতে ভারত ভ্রমণের সময় সিলেট অঞ্চলের নাম উল্লেখ করেছিলেন “শিলিহট” (silihot) হিসেবে। সময়ের সাথে উচ্চারণ ও ভাষার পরিবর্তনে এ নাম “শ্রীহট্ট” এবং পরবর্তীতে “সিলেট”-এ রূপ নেয়।
তান্ত্রিক সূত্র শক্তিসঙ্গমতন্ত্র–এ এ অঞ্চলের নাম “শিলহট্ট” বলা হয়েছে। এছাড়া বৃহন্নীলতন্ত্র, দেবীপুরাণ, ও রুদ্রকহুয়ামাহাত্ম্য–এর মতো ধর্মীয় গ্রন্থেও “শ্রীহট্ট” নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
“শ্রীহট্ট” শব্দটি এসেছে দুটি সংস্কৃত শব্দ থেকে—“শ্রী” (সৌভাগ্য ও দেবী) এবং “হস্ত” (হাত)। এর অর্থ দাঁড়ায় “সৌভাগ্যের দেবীর হাতছোঁয়া ভূমি”।
শিলা ও শিলাহট্ট উপাখ্যান:
আরেকটি মতে, “শিলা” অর্থাৎ পাথর শব্দ থেকেই “সিলেট” নামের উৎপত্তি। আরও জানা যায় যে, গুহক নামক এক রাজা তাঁর কন্যা শিলা–র নামে এ অঞ্চলে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার নাম ছিল “শিলাহট্ট” (অর্থাৎ শিলার হাট)। সময়ের সাথে নামটি “শিলহট” ও “শিলিহট” হয়ে “সিলেট”-এ পরিণত হয়ে থাকতে পারে।
ইসলাম প্রচারের ইতিহাসেও নামটির ব্যাখ্যা মেলে। হজরত শাহ জালাল (রহ.) যখন রাজা গৌরগোবিন্দের শিলার (পাথরের) দুর্গ আক্রমণ করেন, তখন তিনি বলেছিলেন—“শিলা, হট্ট!” অর্থাৎ “পাথর, সরে যাও!”। এ ঘটনাটিও স্থানীয় লোককথায় সিলেট নামের সাথে যুক্ত বলে জানা যায়।
বিদেশি মানচিত্র ও ঐতিহাসিক উল্লেখ:
পর্তুগিজ মানচিত্রকর জোয়াও দে ব্যারোস (João de Barros) ১৬ শতাব্দীতে তাঁর মানচিত্রে সিলেটকে “Reino de Sirote” নামে চিহ্নিত করেন। এতে বোঝা যায়, বিদেশিদের কাছেও “শির” বা “শিল” ধ্বনিটি পরিচিত ছিল।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত ফারসি শিলালিপিতে (খ্রি. ১৫১২–১৫১৩, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ–এর আমলের) “স্রিহত” নাম পাওয়া যায়। একইভাবে, গওসি নামের এক মুসলমান লেখক তাঁর গুলজার-ই আবরার (খ্রি. ১৬১৩) গ্রন্থেও “স্রিহত” শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
নামের বিবর্তন ও ঐতিহ্য:
প্রাচীন “শ্রীহট্ট”, “শিলিহট”, “স্রিহত” থেকে আজকের “সিলেট”—নামের প্রতিটি রূপেই রয়েছে “শ্রী” ও “শিল” শব্দের ঐতিহ্য। সময়, সংস্কৃতি ও উচ্চারণের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সিলেট আজ এক ঐতিহাসিক নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
মুসলিম বিজয়ের পর হজরত শাহ জালাল (রহ.)–এর নামানুসারে কিছু সময় এ অঞ্চলকে “জালালাবাদ” নামেও ডাকা হতো। তবে পরবর্তীতে “সিলেট” নামটি স্থায়ী ও সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে।
পরিশেষে বলা যায় যে, সিলেট নামের ইতিহাস শুধু ভাষার পরিবর্তন নয়, এটি বাঙালির ঐতিহ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতির এক জীবন্ত অধ্যায়। শতাব্দীর বিবর্তনে “সিলেট” নামটি আজ শুধু একটি ভূগোল বিষয় নয় — এটি এক গর্ব, এক পরিচয়।
তথ্যসূত্র:
1. অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি, শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত, (১৩২৪ বঙ্গাব্দ), কথা প্রকাশক, রামগড়, কলকাতা;
2. মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, বেড়াই দেশের মাটি: সিলেট বিভাগ, (২০২৩), অক্ষর প্রকাশনী, ঢাকা।
✍️ লেখক: মো. শাহীন আলম
মানচিত্র: ১৮৮০ সালের বাংলাদেশ মানচিত্র, (wikipedia), Map of “Bengal” from Pope, G. U. (1880), Text-book of Indian History: Geographical Notes, Genealogical Tables, Examination Questions, London: W. H. Allen & Co. Pp. vii, 574, 16 maps
Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL