প্রাচীন লাউড় রাজ্যের হলহলিয়া হাওলী রাজবাড়ি | সুনামগঞ্জ

হলহলিয়া হাওলী রাজবাড়ি
বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলাধীন তাহিরপুর উপজেলার হলহলিয়া গ্রামে সুরক্ষিত প্রাচীরবেষ্টিত প্রাচীন লাউড় রাজ্যের হলহলিয়া হাওলী রাজবাড়ি অবস্থিত। সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে সড়কপথে প্রায় ৪০ কি.মি. পশ্চিম দিকে তাহিরপুর উপজেলা। এ উপজেলা শহর থেকে আঁকাবাঁকা পথে বাঁধাঘাট বাজার হয়ে প্রায় ১৫ কি. মি. উত্তর দিকে হলহলিয়া নামক গ্রামে এ রাজবাড়িটির অবস্থান। বর্ষা মৌসুমে উপজেলা শহর থেকে হাওরের পানিপথে নৌকাযোগে প্রায় ১০ কি.মি. উত্তর দিকে এগিয়ে গেলে একতা বাজার সংলগ্নে অবস্থিত হলহলিয়া হাওলী রাজবাড়িটিতে পৌঁছানো যায়।
প্রাচীন লাউড় রাজ্যের হলহলিয়া হাওলী রাজবাড়িটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংরক্ষিত প্রত্নস্থল (archaeological site)। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে থাকা হলহলিয়া রাজবাড়িটি উত্তর-দক্ষিণে ২৩০ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১০০ মিটার বিস্তৃত। সুরক্ষিত সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এ রাজবাড়িটির ধ্বংসাবশেষ হিসেবে টিকে রয়েছে সিংহ দরজা, প্রাচীর, কথিত অন্ধকূপ, বন্ধীশালা নামক স্থাপনা। স্থানীয় লোকজন এ রাজবাড়িটির উপরে ছোট ছোট বসতঘর স্থাপন করে বসবাস করছে। এ প্রত্নস্থানের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ইটের টুকরো ও মৃৎপাত্রের ভগ্ন টুকরো দৃশ্যমান। রাজবাড়ি এ প্রত্নস্থানে কিছুটা মাটি খুড়লে বেরিয়ে আসে ইট দিয়ে নির্মিত প্রাচীন স্থাপত্যিক নিদর্শনের ধ্বংসাবশেষ।

২০২০ সালের প্রত্নতাত্ত্বিক খননে হলহলিয়া রাজবাড়িটির অভ্যন্তরে একাধিক প্রবেশপথবিশিষ্ট ১টি কক্ষ, কক্ষের মেঝে, কক্ষটির পূর্বপাশে লাগোয়া দেয়াল ও মেঝের অংশবিশেষ এবং দুর্গের সীমানা প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষের অংশবিশেষ উন্মোচিত হয়েছে । উন্মোচিত কক্ষের দেয়াল নির্মাণে পাতলা ইট, পাথরের বোল্ডার ও চুনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। উন্মোচিত কক্ষের ১০৫ সে.মি. চওড়া দেয়ালগুলোতে ব্যবহৃত ইটের পরিমাপ ২০ সে.মি. × ১২ সে.মি. × ৩.৫ সে.মি. ও ১৬ সে.মি. × ৭.৫ সে.মি. × ৪ সে.মি.। মেঝের উপর থেকে নিচে তিনটি স্তরে ব্যবহার করা হয়েছে চুন-সুরকির আস্তর, পাতলা ইটের সলিং এবং পাথরের বোল্ডার। খননকালে মাটির বিভিন্ন স্তরে পোড়ামাটির বিভিন্ন প্রত্নবস্তুর ভগ্নাংশ পাওয়া যায়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়, কুমিল্লার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধান দল সুনামগঞ্জ জেলার এ হলহলিয়া রাজবাড়িতে ২০২০ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ পরিচালনা করে। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে খনন কাজ পরিচালনা করে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়, কুমিল্লার একটি প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধান দল। এ দলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন ফিল্ড অফিসার মো: শাহীন আলম।
উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সালের প্রথম পরীক্ষামূলক প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে হলহলিয়া হাওলী রাজবাড়িটিতে স্থাপত্যিক কাঠামোসহ কথিত সিংহ দরজা, বন্দীশালা, মৃত্যু কূপ, সীমানা প্রাচীর প্রভৃতি দৃশ্যমান হয়।

সিলেটের ইতিহাস নামক গ্রন্থের ২০৮-২০৯ পৃষ্ঠায় সৈয়দ জয়নাল আবেদীন তাঁর লিখিত ‘‘সিলেটের খন্ড খন্ড স্বাধীন রাজ্য” শীর্ষক প্রবন্ধের অংশ উল্লেখ করেন যে,
”খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সাল হতে ১০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বর্তমান সিলেট বিভাগ ভুক্ত অঞ্চল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল বলে ইতিহাসবিদগণ মত প্রকাশ করেছেন।
ব্রিটিশ আমলের সিলেট জেলাভুক্ত অঞ্চল কয়েকটি ছোট বড় রাজ্যে বিভক্ত ছিল। কোন কোনটি শত শত বৎসর স্বাধীনভাবে শাসিত হয়ে আসছিল। এ রাজ্যগুলির মধ্যে রয়েছে-
১। লাউড় (বর্তমান সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার অধিকাংশ অঞ্চল। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল বানিয়াচঙ ও জগন্নাথপুর)।’’
সৈয়দ জয়নাল আবেদীন আরও উল্লেখ করেন যে, লাউড়
‘‘সিলেট জেলার হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার অধিকাংশ স্থান নিয়া এই রাজ্য গঠিত ছিল। ইহা ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলিয়া অনুমান করা হয়। ইহা একটি বৃহৎ রাজ্য ছিল। এই রাজ্যে কে কখন রাজত্ব করেন তাহার নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায় না। জনৈক কেশবকে লাউড় রাজ্যর পূর্ব পুরুষ বলিয়া চিহ্নিত করা হয়। কেশব মিশ্র ভাগ্যন্নোয়নকল্পে কনৌজ হইতে এই দেশে (লাউড়) আসিয়া বসবাস করিতে থাকেন। কেশবচন্দ্র হইতে তদীয় বংশধর রাজা গোবিন্দচন্দ্রকে তাহার দশম পুরুষ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এই গোবিন্দচন্দ্র মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতঃ রাজা হাবিব খান নামে অভিহিত হন।’’
অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি-এর শ্রীহট্টের ইত্তিবৃত্ত পূর্বাংশ গ্রন্থের ১৩৬ পৃষ্ঠায় প্রাচীনকালে শ্রীহট্ট লাউড়, গৌড় ও জয়ন্তীয়া এই তিন ভাগে বিভক্ত ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তত্ত্বনিধি তাঁর এ গ্রন্থের ৪১ পৃষ্ঠায় হাওরের অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ’’সুনামগঞ্জের অধীন হাওরগুলি: ২. শনির হাওর– শ্রীহট্ট সহর হইতে ৫০ মাইল পশ্চিম উত্তরে লাউড় পরগনায় অবস্থিত।’’
তত্ত্বনিধি তাঁর এ গ্রন্থের ২০৭ পৃষ্ঠায় আরও উল্লেখ করেন, ‘‘লাউড় গৌড়ের পশ্চিমে অর্থাৎ শ্রীহট্ট জিলার পশ্চিমাংশ ব্যাপিয়া লাউড় রাজ্য ছিল।’’

তত্ত্বনিধির গ্রন্থের শ্রীহট্ট সহর বলতে বর্তমানের সিলেট শহরকে বুঝানো হয়েছে। উপর্যুক্ত এসব তথ্য সূত্র ধরে বর্তমানের সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার মানচিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বর্তমান সিলেট শহর (শ্রীহট্ট সহর) থেকে হলহলিয়া রাজবাড়িটি প্রায় ৪৬.৫ মাইল উত্তর-পশ্চিমে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার হলহলিয়া গ্রামে অবস্থিত। আর উল্লেখিত শনির হাওর হলহলিয়া রাজবাড়ির সন্নিকটেই অবস্থিত। সূতরাং হলহলিয়া হাওলী রাজবাড়িটি শ্রীহট্টের অন্যতম প্রাচীন জনপদ লাউড় রাজ্যের (পরগনার) ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে অবস্থিত। আবার এ ভৌগোলিক এলাকায় কামরূপ রাজ্য, ত্রিপুরা রাজ্য ও প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের শাসন ছিল বলে ঐতিহাসিক গ্রন্থসূত্রে জানা যায়। ধারাবাহিকভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকালে উন্মোচিত স্থাপত্যিক নিদর্শন ও প্রত্নবস্তুসমূহ অধিকতর বিশ্লেষণ ও গবেষণা করে প্রকৃতপক্ষে হলহলিয়া হাওলী রাজবাড়িটি কোন শাসন আমলের হতে পারে, তা জানা প্রয়োজন। [মো. শাহীন আলম]
তথ্যসূত্র:
১. আবেদীন, সৈয়দ জয়নাল, ‘‘সিলেটের খন্ড খন্ড স্বাধীন রাজ্য”, সিলেটের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২০৮-২০৯;
২. তত্ত্বনিধি, অচ্যুতচরণ চৌধুরী , শ্রীহট্টের ইত্তিবৃত্ত পূর্বাংশ, পৃষ্ঠা, ৪১, ১৩৬;
৩. প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ, আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়, কুমিল্লা।
Follow Us in Our Youtube Channel: GEONATCUL