প্রাচীন যুগে ভূগোলের বিকাশ: গ্রীক পণ্ডিতদের অবদান
ভূগোল [geography] জ্ঞানের শুরু বহু পুরোনো। যখন মানুষ বুঝতে পারলো যে খাবার-দাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে, তখন থেকেই জায়গা ও অবস্থানের গুরুত্ব তাদের কাছে বাড়তে শুরু করে। প্রাচীন গ্রীক পণ্ডিতরা পৃথিবী সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলোকে ভাগ করেছিলেন দুইভাগে—
১) ভূগোল: পৃথিবীর ভূমি ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা।
২) মহাজাগতিক বিদ্যা: আকাশ, নক্ষত্র আর মহাজগত নিয়ে আলোচনা।
তাঁরা শুধু পৃথিবীর অবস্থান জানতেই থেমে থাকেননি, বরং বিভিন্ন জায়গার পার্থক্য আর তার কারণ বোঝার চেষ্টাও করেছিলেন।
১. হেকাটিয়াস (Hecataeus, 550–476 BCE)
হেকাটিয়াস ছিলেন প্রাচীন গ্রিক ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদ। ভূমধ্যসাগর, দ্বীপ আর দূরের জায়গাগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। তাঁর রচিত Periodos Ges বা Travels round the Earth ছিল ভূগোলের প্রথম দিকের বইগুলোর একটি। বইটিতে তিনি ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের বিবরণ দিয়েছেন এবং এনাক্সিমেন্ডারের তৈরি মানচিত্রকে সংশোধন করে সংযোজন করেছিলেন।
২. হেরোডোটাস (Herodotus, 484–425 BCE)
হেরোডোটাসকে “ইতিহাসের জনক” বলা হয়। তিনি কৃষ্ণসাগর, রাশিয়ার স্তেপ অঞ্চল ও পারস্যের মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে লিখেছেন। মিসর ভ্রমণের সময় নীলনদকে তিনি “মিসরের দান” বলেন। নীলনদের মোহনায় পলি জমে যে আকৃতি তৈরি হয়েছিল, সেটিকে গ্রিক অক্ষর ডেল্টা (Δ)-র সঙ্গে মিলিয়ে তিনি প্রথম “ডেল্টা” নাম দেন।

৩. অ্যারিস্টটল (Aristotle, 384–322 BCE)
অ্যারিস্টটল বৈজ্ঞানিকভাবে পৃথিবী গোলাকার প্রমাণ করেন। তিনি দেখান, চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর ছায়া সবসময় গোলাকার দেখা যায়। তাঁর মতে, ভিন্ন ভিন্ন অক্ষাংশে আবহাওয়া ও মানুষের জীবনযাত্রার ভিন্নতা তৈরি হয়।
৪. ইরাটোসথেনিস (Eratosthenes, 276–194 BCE)
ইরাটোসথেনিসকে বলা হয় প্রাকৃতিক ভূগোলের অগ্রদূত। তিনি প্রথম সাধারণ জ্যামিতির সাহায্যে পৃথিবীর পরিধি প্রায় সঠিকভাবে পরিমাপ করেন—৪০,২৩৩ কিলোমিটার (আধুনিক হিসাব ৪০,০৭২ কিলোমিটার)। এই সামান্য পার্থক্য আজও বিস্ময়কর। তিনি অক্ষাংশ–দ্রাঘিমা ব্যবহার করে স্থান নির্ধারণের পদ্ধতি চালু করেন এবং পৃথিবীকে নিরক্ষীয়, মেরু ও নাতিশীতোষ্ণ বলয়ে ভাগ করে মানচিত্র তৈরি করেন।

৫. হিপারকাস (Hipparchus)
হিপারকাস পৃথিবীকে জলবায়ু অঞ্চলে ভাগ করেছিলেন এবং সমতল কাগজে গোলাকার পৃথিবী আঁকার কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন।
৬. স্ট্র্যাবো (Strabo, 64 BC–20 ACE)
স্ট্র্যাবো ছিলেন রোমান সাম্রাজ্যের খ্যাতনামা ভূগোলবিদ ও ভ্রমণকারী। তাঁর লেখা Historical Memoirs-এর ১৭টি খণ্ড পাওয়া গেছে। তিনি ভূগোলকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন—প্রাকৃতিক, গাণিতিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক। তিনি “Ecumene” শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন বাসযোগ্য পৃথিবী বোঝাতে।

৭. টলেমি (Ptolemy, 100–178 ACE)
টলেমির Geographike Hyphegesis বা Guide to Geography গ্রন্থে প্রচুর ভৌগোলিক তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছিল। তিনি মানচিত্র অঙ্কনের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন এবং অক্ষাংশ–দ্রাঘিমার মাধ্যমে স্থানের সঠিক অবস্থান নির্ণয়ের প্রচলন করেন। তাঁর মানচিত্রে প্রথমবারের মতো বঙ্গোপসাগর, গঙ্গা নদী ও হিমালয় পর্বতের উল্লেখ পাওয়া যায়।

৮. প্লিনি জুনিয়র (Pliny the Younger, 61–113 ACE)
প্লিনি জুনিয়র নেপলস উপসাগরে নৌকা থেকে দাঁড়িয়ে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত দেখেছিলেন এবং সেই ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ লিখে গেছেন। তিনি বর্ণনা করেছিলেন, কীভাবে আগ্নেয়গিরির মেঘ ব্যাঙের ছাতার মতো আকার ধারণ করে পম্পাই ও হারকোলেনিয়াম শহরকে জীবন্ত কবর দিয়েছিল। ধ্বংসযজ্ঞের সময় তিনি জানতেন না, তাঁর চাচা তখনই লাভার স্রোতে প্রাণ হারাচ্ছেন।
প্রাচীন যুগে ভূগোলবিদ্যার যে ভিত্তি তৈরি হয়েছিল, তা মূলত গড়ে উঠেছিল গ্রিক পণ্ডিতদের হাতে। হেকাটিয়াসের মানচিত্র, হেরোডোটাসের ভ্রমণ বর্ণনা, অ্যারিস্টটলের গোলাকার পৃথিবীর ধারণা, ইরাটোসথেনিসের পৃথিবীর সঠিক পরিমাপ কিংবা টলেমির ভৌগোলিক সংকলন—সব মিলিয়ে ভূগোল একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানচর্চায় পরিণত হয়। তাঁদের এই অবদান শুধু প্রাচীন যুগের বিজ্ঞানকেই সমৃদ্ধ করেনি, বরং আধুনিক ভূগোল ও মানচিত্রবিদ্যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে। আজকের উন্নত প্রযুক্তি-নির্ভর ভৌগোলিক গবেষণার পেছনে তাই এই প্রাচীন গ্রিক পণ্ডিতদের অবদান অমূল্য হয়ে আছে।
✍️ লেখক: মো. শাহীন আলম
🔗 সহায়িকা:
১। Singh, Savindra, (2009), Physical Geography, Prayag Pustak Bhawan, Allahbad, India;
২। রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, (২০১৭ – ২০১৮), প্রাকৃতিক ভূগোল, কবির পাবলিকেশনস, ঢাকা;
৩। রউফ, কাজী আবদুর, (২০০২), প্রাকৃতিক পরিবেশ, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা;
৪। রউফ, কাজী আবদুর, (২০১১), প্রাকৃতিক ভূগোল পরিচিতি, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা।
Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL