মধ্যযুগে ভূগোলের বিকাশ: আল-বিরুনি থেকে কান্ট

ভূগোলের [Geography] ইতিহাস মানবসভ্যতার বিকাশের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। তবে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপে জ্ঞানচর্চা স্থবির হয়ে পড়ে। এই দীর্ঘ সময়কে ইতিহাসে মধ্যযুগ বলা হয়। খ্রিস্টীয় ৩০০ সাল থেকে ১৪৮৬ সালে বার্থোলোমিউ দিয়াজের উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ পর্যন্ত সময় এর অন্তর্ভুক্ত।

ইউরোপীয়রা মধ্যযুগকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে:
১. খ্রিস্টীয় ৩০০–৯০০ সাল → অন্ধকার যুগ
২. খ্রিস্টীয় ৯০০–১৪৮৬ সাল → ধর্মযুদ্ধের যুগ

এই সময়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেমে থাকলেও তীর্থযাত্রী, ভ্রমণকারী ও পরবর্তীকালে সমুদ্র অভিযাত্রীদের মাধ্যমে ভূগোল জ্ঞান বিকাশ লাভ করে। বিশেষত ইসলামী সভ্যতার ভূগোলবিদরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

আল-মাসুদী (৮৯৬–৯৫৬ খ্রি.)

তিনি পৃথিবী গোলাকার বলে প্রমাণ দেন। ভূমিরূপ, ক্ষয়চক্র, মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ ও জাহাজ চলাচলে বায়ুর ভূমিকা সম্পর্কে মতামত দেন।

আল-মাসুদীর পৃথিবীর মানচিত্র, সূত্র: wikimedia.org

আল-বিরুনি (৯৭৩–১০৪৮ খ্রি.)

বহু বিষয়ে পারদর্শী আল-বিরুনি ভূগোলের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। তাঁর কিতাব আল হিন্দ গ্রন্থে ভারতের সমভূমিকে নদীবাহিত পলিসঞ্চয়ের মাধ্যমে গঠিত বলে উল্লেখ করা হয়। তিনি খাঁড়ি ও উপসাগরের পার্থক্য নির্ধারণ করেন, জোয়ার-ভাটার কারণ ব্যাখ্যা করেন এবং পৃথিবীর আকার পরিমাপের চেষ্টা করেন।

আল-ইদ্রিসি (১১৫৪ খ্রি.)

স্পেনীয় এই ভূগোলবিদ মানচিত্র প্রণয়নে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি পৃথিবীর পরিধি প্রায় ২২,৯০০ মাইল বলে উল্লেখ করেন এবং একে ৭টি জলবায়ু অঞ্চল ও ৭০টি উপবিভাগে ভাগ করেন।

ইবনে খালদুন (১৩৩২–১৪০৬ খ্রি.)

তিনি অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা নির্ণয়ের কৌশল ব্যাখ্যা করেন। সূর্যের অবস্থান ও কিরণের কোণের ওপর উষ্ণতার পার্থক্য দেখান। এছাড়া জলবায়ুর সাথে মানুষের আচরণ, জীবনধারা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন।

ইবনে খালদুনের পৃথিবীর মানচিত্র, সূত্র: wikimedia.org

মার্টিন বেহাইম (১৪৯২ খ্রি.)

তিনি পৃথিবীর প্রথম গ্লোব তৈরি করেন, যা ভূগোল জ্ঞানে যুগান্তকারী প্রভাব ফেলে।

বেরনহারডাস ভেরেনিয়াস (১৬২২–১৬৫০ খ্রি.)

তাঁর Geographia Generalis (১৬৫০) ভূগোলকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেয়। তিনি ভূগোলকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন: পরম, আপেক্ষিক ও তুলনামূলক। একই সাথে ভূগোলকে সাধারণ ও বিশেষ অংশে বিভক্ত করেন।

ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪–১৮০৪ খ্রি.)

জার্মান দার্শনিক কান্ট ভূগোলকে জ্ঞানবিজ্ঞানের একটি রীতিবদ্ধ শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রাকৃতিক, গাণিতিক, নীতিশাস্ত্র, রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও ঐশ্বরিক—এই ছয় ভাগে ভূগোলকে বিভক্ত করেন। তাঁর নীহারিকা তত্ত্ব প্রাকৃতিক ভূগোলের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ।

উনবিংশ শতকে বিকাশ

শিল্পবিপ্লবের ফলে কাঁচামাল সংগ্রহ ও উপনিবেশ বিস্তারের প্রয়োজনে ইউরোপ ভূগোল জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগ স্থাপন ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভূগোল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করে।

মধ্যযুগে ইউরোপীয় জ্ঞানচর্চা স্তব্ধ থাকলেও ইসলামী পণ্ডিতদের অবদান ভূগোলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে ভেরেনিয়াস ও কান্ট ভূগোলকে বৈজ্ঞানিক ও রীতিবদ্ধ আকার দেন। আর উনবিংশ শতকের শিল্পবিপ্লব ভূগোলকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে আধুনিক যুগের পথে এগিয়ে দেয়।


✍️ লেখক: মো. শাহীন আলম


🔗 সহায়িকা:
১। Singh, Savindra, (2009), Physical Geography, Prayag Pustak Bhawan, Allahbad, India;
২। রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, (২০১৭ – ২০১৮), প্রাকৃতিক ভূগোল, কবির পাবলিকেশনস, ঢাকা;
৩। রউফ, কাজী আবদুর, (২০০২), প্রাকৃতিক পরিবেশ, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা;
৪। রউফ, কাজী আবদুর, (২০১১), প্রাকৃতিক ভূগোল পরিচিতি, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা।


Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL


Leave a Reply