কার্বন চক্রে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য এবং মানুষের ভূমিকা
পৃথিবীতে কার্বন বিভিন্ন যৌগ রূপে ভৌত পরিবেশ এবং জীব পরিবেশে বিরাজ করে। বায়ুমণ্ডল, বারিমণ্ডল ও অশ্মমণ্ডল ভৌত পরিবেশের ৩টি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বায়ুমণ্ডলে গ্যাসীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড রূপে কার্বন পাওয়া যায়। বারিমন্ডলে জলীয় কার্বোনেট এবং বাই-কার্বোনেট আয়ন রূপে কার্বন পাওয়া যায়। অশ্মমণ্ডলে সঞ্চিত জীবাশ্ম জ্বালানী যেমন- কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস রূপে কার্বন পাওয়া যায়। বায়ুমণ্ডলের ট্রপোমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৩৩০ ppm। যা শতকরা হিসেবে ০.০৩২। বায়ুমণ্ডলের তুলনায় সমুদ্রের পানিতে ৫০গুণ বেশি কার্বন রয়েছে। আবার জীব পরিবেশের অংশ হল প্রাণী, উদ্ভিদ ও জীবাণু। প্রোটিন, লিপিড এবং কার্বো-হাইড্রেট জাতীয় বৃহৎ অণু দিয়ে গঠিত প্রাণী, উদ্ভিদ ও জীবাণুর সংগঠক উপাদান হিসেবে কার্বন উপস্থিত থাকে। নিম্নে কার্বন চক্র এবং কার্বন চক্রে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য এবং মানুষের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হল:
কার্বন চক্র (carbon cycle): কার্বন চক্র বলতে কার্বনের চক্রাকার প্রবাহকে বুঝায়। অর্থাৎ ভৌত পরিবেশ থেকে জীব পরিবেশে এবং জীব পরিবেশ থেকে ভৌত পরিবেশে কার্বনের যে চক্রাকার প্রবাহ রয়েছে তাকেই কার্বন চক্র বলে। জীব পরিবেশের অস্তিত্বের জন্য কার্বন একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। উদ্ভিদ ভৌত পরিবেশের বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড রূপে কার্বন গ্রহণ করে। পরবর্তীতে এ কার্বন খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে প্রাণীদেহে প্রবাহিত হয়। বিশেষ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড রূপে কার্বন ভৌত পরিবেশে প্রবাহিত হয়। এভাবে কার্বন ভৌত পরিবেশ থেকে জীব পরিবেশে পুনরায় প্রবাহিত হতে থাকে।
কার্বন চক্রের পদ্ধতি (the mechanism of carbon cycle): ভৌত পরিবেশ থেকে জীব পরিবেশে কার্বনের অন্তর্প্রবাহ এবং জীব পরিবেশ থেকে ভৌত পরিবেশে কার্বনের বহির্প্রবাহের মাধ্যমে কার্বন চক্র সম্পন্ন হয়। তাই কার্বন চক্রের পদ্ধতিকে দুটি কার্বন প্রবাহে ভাগ করে নিন্মে ব্যাখ্যা করা হল।
১. ভৌত পরিবেশ থেকে জীব পরিবেশে কার্বনের অন্তর্প্রবাহ: উদ্ভিদ ভৌত পরিবেশের বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। গৃহীত এ কার্বন-ডাই-অক্সাইড সৌরশক্তির সাহায্যে জৈব খাদ্য অণুতে রূপান্তরিত হয়। খাদ্য অণুতে রূপান্তরিত হওয়ার এ প্রক্রিয়াটিকে সালোকসংশ্লেষণ (photosynthesis) বলা হয়। খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে জৈব খাদ্য অণু প্রাণীদেহে প্রবাহিত হয়।
6CO2 | + | 6H2O | + | Solar Energy | → | C6H12O6 | + | 6O2 |
কার্বন-ডাই-অক্সাইড | + | পানি | + | সৌরশক্তি | → | কার্বো-হাইড্রেট | + | অক্সিজেন |
২. জীব পরিবেশ থেকে ভৌত পরিবেশে কার্বনের বহির্প্রবাহ: কার্বন জীব পরিবেশ থেকে ভৌত পরিবেশে প্রবাহের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর কোষীয় শ্বসন প্রক্রিয়াটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোষীয় শ্বসন প্রক্রিয়ায় কার্বনযুক্ত জৈব খাদ্য অণু অক্সিজেনের সাহায্যে জারিত হয়। জারিত হওয়ার সময় শক্তি, তাপ এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদিত হয়। একে আবার সালোকসংশ্লেষণ (photosynthesis) প্রক্রিয়ার বিপরীত প্রক্রিয়া বলা হয়। কোষীয় শ্বসনকালে উৎপাদিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড আবার ভৌত পরিবেশের বায়ুমণ্ডলে প্রবাহিত হয়। উদ্ভিদ পুনরায় বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে।
C6H12O6 | + | 6O2 | → | 6CO2 | + | 6H2O | + | Energy | + | Heat |
কার্বো-হাইড্রেট | + | অক্সিজেন | → | কার্বন-ডাই-অক্সাইড | + | পানি | + | শক্তি | + | তাপ |
এছাড়াও ডেট্রিভোর এবং ডিকম্পোজার জীব যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক প্রভৃতি প্রাণীর বর্জ্য পদার্থ এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত দেহ থেকে শ্বসন প্রক্রিয়ায় শক্তি আরোহণকালে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদন করে। উৎপাদিত এ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। প্রাকৃতিক উপায়ে কিংবা মানুষ কর্তৃক অরণ্য বা বন দহন করলে (দাবানলে) উদ্ভিদদেহের কার্বন গ্যাসীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড রূপে বায়ুমণ্ডলে নি:সরিত হয়। মানুষ কর্তৃক কাঠ, কয়লা, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি দহনের কারণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড রূপে কার্বন বায়ুমণ্ডলে নি:সরিত হয়ে থাকে।
চিত্র: কার্বন চক্র।
কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য এবং মানুষের ভূমিকা: বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য নির্ভর করে ভৌত পরিবেশ থেকে জীব পরিবেশে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের গ্রহণ বা ব্যবহার এবং জীব পরিবেশ থেকে ভৌত পরিবেশে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নি:সরণের সুষম আন্ত:ক্রিয়ার উপর। মানুষের অপরিকল্পিত কাজের কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নি:সরণের পরিমাণ বেড়ে যায়। অপরদিকে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের গ্রহণ কিংবা ব্যবহারের পরিমাণ কমে যায়। ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ক্রমাগত হারে বাড়ে। বায়ুদূষণ বিশেষ করে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হল বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। এক হিসেবে দেখা যায়, নিম্নলিখিত মানুষের অপরিকল্পিত কাজের কারণে প্রতি বছর ১০×১০১২ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বায়ুমণ্ডলে নি:সরিত হয়।
ক. খনি থেকে উত্তোলিত কার্বন যৌগের কয়লা, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানীর ক্রমবর্ধমান হারে ব্যবহার। এ জীবাশ্ম জ্বালানীর দহনের কারণে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বায়ুমণ্ডলে নি:সরিত হয়।
খ. নির্বিচারে বনভূমির উদ্ভিদ বা অরণ্য নিধন করে সবুজ আচ্ছাদনের বিলুপ্ত করা। ফলে উদ্ভিদ বা অরণ্য কর্তৃক কার্বন-ডাই-অক্সাইডের গ্রহণ বা ব্যবহার পরিমাণ হৃাস পায়। [মো. শাহীন আলম]
তথ্যসূত্র: ১. পাল, গৌতম, পরিবেশ ও দূষণ, দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লি., কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৬৩-৬৫।