প্লেট টেকটোনিক্স: প্লেট টেকটোনিক মতবাদ

প্লেট টেকটোনিক্স [Plate Tectonics] বলতে সাধারণত পৃথিবীর উপরের আবরণ বা ভূত্বকের গঠন রূপ এবং এর পরিবর্তন সম্পর্কিত এক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে বুঝায়। প্লেট টেকটোনিক্স নিয়ে বিগত বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে এক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়। এ তত্ত্ব বা মতবাদের মূল কথা হল পৃথিবীর উপরের আবরণ বা ভূত্বক একাধিক খণ্ড খণ্ড পাত বা ফলকের (plates) সমষ্টি। বিজ্ঞানীদের মতে, এসব ফলকের এক একটির পুরুত্ব ভূ-অভ্যন্তরের দিকে আনুমানিক ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। সিয়াল (SiAl) দিয়ে গঠিত কেবল স্থলভাগের ফলকগুলোকে মহাদেশীয় ফলক (continental plate) বলে। সিমা (SiMa) দিয়ে গঠিত কেবল জলভাগের ফলকগুলোকে মহাসাগরীয় ফলক (oceanic plate) বলে। এর মধ্যে স্থল ও জলভাগের ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত কতিপয় ফলক রয়েছে; যেগুলো মহাদেশ ও মহাসাগর উভয় ভূখণ্ডের অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত। পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরের উত্তপ্ত পরিস্থিতি এবং ভূ-আলোড়নসহ বিভিন্ন কারণে এ ফলকগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হয়ে থাকে। এ ফলকগুলোর প্রান্তসীমায় পরস্পরের সংঘর্ষস্থলে পর্বতমালা এবং আগ্নেয়গিরিবিশিষ্ট ভূমিরূপ দেখা যায়। এছাড়া ফলকগুলোর প্রান্তসীমায় পরস্পরের সংঘর্ষস্থলে প্রতিনিয়ত ভূমিকম্পের মত ঘটনাও ঘটে থাকে।

প্লেট টেকটোনিক মতবাদ [Plate Tectonic Theory]: ১৯১২ অব্দে আলফ্রেড ওয়েগনারের (Alfred Wegener) প্রদত্ত মহাদেশ সঞ্চালন মতবাদের (continental drift theory) প্রতিফলন স্বরূপ প্লেট টেকটোনিক মতবাদের (plate tectonic theory) উদ্ভব হয়েছে। একে বাংলা ভাষাতে আবার ফলক ভূগাঠনিক মতবাদ বা ফলক সঞ্চালন মতবাদ বা পাত সঞ্চালন মতবাদও বলা হয়। প্লেট টেকটোনিক মতবাদটিতে প্রচুর তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। এ মতবাদটিতে ভূত্বকের প্লেট বা ফলকগুলাের (plates) স্থানান্তর সম্পর্কিত সমালোচনার বিষয় এবং পুরাতন আপত্তিগুলো সংশােধন করা হয়েছে।

প্লেট টেকটোনিক মতবাদের ভিত্তি [Base of Plate Tectonic Theory]: মেরুর স্থান পরিবর্তন, মহাদেশীয় ভূভাগের সঞ্চালন ও সমুদ্রতলের সম্প্রসারণের ফলাফল বর্ণনা করার জন্য এ মতবাদে প্লেট টেকটোনিক (Plate Tectonic) শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠকে ছােট বড় কয়েকটি ফলকে (plate) বিভক্ত করে এ মতবাদের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। আর এসব ফলকের এক একটির আয়তন কয়েক হাজার বর্গ কিলোমিটার থেকে কয়েক কোটি বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

map of earth's oceans and continents with boundaries of tectonic plates highlighted

ফলকসমূহ [Plates]: ভূবিজ্ঞানীগণ সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন ফলকের (plates) অবস্থানের বিষয়ে একমত হয়েছেন। প্লেট টেকটোনিক মতবাদে সমগ্র পৃথিবীকে ছোট বড় বিভিন্ন আয়তনের সর্বমােট ২৭টি ফলকে (plates) ভাগ করা হয়। এ ফলকগুলোর মধ্যে ৭টি আকারে বড়। আর ৭টি বৃহৎ আকৃতির ফলক হল:

(১) প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফলক (Pacific Ocean Plate),
(২) ইউরেশিয়ান ফলক (Eurasia Plate),
(৩) উত্তর আমেরিকা ফলক (North American Plate)
(৪) দক্ষিণ আমেরিকা ফলক (South American Plate) 
(৫) আফ্রিকান ফলক (African Plate)
(৬) ইন্দো-অস্ট্রেলীয় ফলক (Indo-Australian Plate) ও
(৭) এন্টার্কটিকা ফলক (Antarctic Plate)

এবং ২০টি ছােট আকৃতির ফলক রয়েছে। ছােট আকৃতির ফলকের মধ্যে

(৮) নাজকা ফলক (Nazca Plate or Nasca Plate)
(৯) ফিলিপাইন ফলক (Philippines Plate)
(১০) কোকস ফলক (Cocos Plate) ও
(১১) ক্যারিবীয় ফলক (Caribbean Plate) উল্লেখযােগ্য।

প্লেট টেকটোনিক মতবাদের উদ্ভব [Origin of Plate Tectonic Theory]: আলোচ্য প্লেট টেকটোনিক মতবাদটি কোন একজন ভূবিজ্ঞানী এককভাবে উপস্থাপন করেননি। বরং এ মতবাদটি হল বহু ভূ বিজ্ঞানীর সম্মিলিত অবদানের প্রেক্ষিত প্রতিষ্ঠিত একটি পৃথিবীর ভূগাঠনিক বা ফলক সঞ্চালনের ধারণা। ইতোপূর্বে মহাদেশ ও পর্বতের গঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট মতবাদ নিয়ে অনেক আপত্তি ও বিরূপ সমালােচনা হয়েছে। এ সব আপত্তি ও বিরূপ সমালােচনা কাটিয়ে উঠার জন্য প্লেট টেকটোনিক মতবাদ বা ফলকীয় সঞ্চালনের ধারণাটি ক্রমশ প্রকাশ পায়। প্লেট টেকটোনিক মতবাদটি আলফ্রেড ওয়েগনারের মহাদেশ সঞ্চালন মতবাদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। প্লেট টেকটোনিক মতবাদে ধরে নেয়া হয় যে, কোন এক সময়ে মহাদেশীয় ভূভাগগুলাে একত্রে একটি সম্মিলিত ভূভাগ ছিল। প্যাঞ্জিরা বা প্যানজিয়া (Pangaea) নামে পরিচিত এ সম্মিলিত ভূভাগের উত্তরাংশের নাম লরেশিয়া (Laurasia) ও দক্ষিণাংশের নাম গন্ডােয়ানা (Gondwana)। পরবর্তীকালে প্যানজিয়াটি টুকরো টুকরো হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে বর্তমানের বৃহৎ আকৃতির ৭টি মহাদেশের উদ্ভব হয়েছে। তবে এ মতবাদে মহাদেশগুলোর সঞ্চালন সৃষ্টিকারী শক্তি পূর্ববর্তী মতবাদে (আলফ্রেড ওয়েগনারের প্রদত্ত মহাদেশ সঞ্চালন মতবাদ) উল্লেখিত শক্তি থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরনের।

প্লেটের চালিকা শক্তি [Driving Force of the Plate]: প্লেট টেকটোনিক মতবাদ অনুসারে, পৃথিবীর ভূত্বকের নিচে জটিল ‘পরিচলন স্রোত’ প্রবাহিত অবস্থায় রয়েছে। গলন থেকে কঠিন এবং কঠিন থেকে পুনরায় গলন প্রভৃতি বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে পরিচলন স্রোত আংশিক গলিত পদার্থগুলােকে নিচের দিকে অবনমন মণ্ডলে চালিত করে। সম্পূর্ণরূপে না গলা পর্যন্ত নিচের দিকে সঞ্চালনশীল ফলকগুলাে (plates) ভূ-অভ্যন্তরে প্রায় ৭০০ কিলােমিটার গভীরে প্রবেশ করে। অপরপক্ষে উপরের দিকে সঞ্চালনশীল উষ্ণ পদার্থগুলো কেন্দ্র থেকে উপরিভাগে উঠে আসে। কেন্দ্র থেকে উপরিভাগে উঠে দূরে সরে যাওয়ার সময় তা ধীরে ধীরে শীতল হয়। পরবর্তীকালে আরও শীতল হয়ে কঠিন ও শক্ত অশ্মমন্ডলে (Lithosphere) পরিণত হয়। সর্বশেষ শীতল হওয়ার পরে অশ্মমণ্ডলীয় ফলক (plate) অবনমিত এলাকায় গুরুমন্ডলের (barysphere) মধ্যে প্রবেশ করে। পুনরায় সে সব একত্রিত হয়ে উত্তপ্ত হতে থাকে এবং ভবিষ্যতে উপরের দিকে উঠে আসার জন্য প্রস্তুত হয়। তাছাড়া ধাক্কা ও আকর্ষণ শক্তির প্রভাবে ফলকগুলাে (plates) সঞ্চালিত হয় বা গতি লাভ করে।

ফলকের সঞ্চালন [Movement of the Plates]: পৃথিবীর মহাদেশীয় ও সামুদ্রিক উভয় ভূত্বকে আলাদা আলাদা একাধিক ফলক (plates) রয়েছে। মহাদেশীয় ভূভাগকে নিয়ে সঞ্চালনশীল ফলকগুলাের এক স্থান থেকে অন্যত্র অগ্রসর হয়। অর্থাৎ ফলকের অগ্রসরের সাথে সাথে মহাদেশীয় ভূভাগ সঞ্চালিত হয়। এর নিচে রয়েছে গুরুমন্ডলের উর্ধ্বস্তর, যা আংশিক গলিত ও নমনীয়। এ উর্ধ্বস্তরকে বলা হয় নতুন অশ্মমন্ডল তৈরির উৎস।

ফলক সঞ্চালন গতির প্রকারভেদ [Types of the Plate Movement]: মহাদেশীয় ও মহাসাগরীয় ছােট থেকে বড় সব কয়টি ফলক (plates) সব সময় সঞ্চালনশীল অবস্থায় রয়েছে। ফলক সঞ্চালন গতিকে ৩ (তিন) ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হল –

(ক) সম্প্রসারণ গতি/ অপসারী (Extensional Movement)

(খ) সংকোচন গতি/ অভিসারী (Compressional Movement) এবং

(গ) পার্শ্বীয় গতি/ পাশাপাশি (Lateral Movement)। নিম্নে ফলক সঞ্চালন গতিগুলাে সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

সম্প্রসারণ গতি/ অপসারী

(ক) সম্প্রসারণ গতি/ অপসারী (Extensional Movement): পাশাপাশি অবস্থিত ২টি ফলক (plates) যখন তাদের প্রকৃত অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে পরস্পরের বিপরীত দিকে সঞ্চালিত হয়, তখন সে অবস্থাটিকে প্লেট বা ফলকের সম্প্রসারণ গতি/ অপসারী বলে। সম্প্রসারণ গতির দ্বারা স্থানচ্যুত হলে ফলক ২টির সীমান্তে ভূপৃষ্ঠের চাপ ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে এবং ফাটলসহ খালি জায়গার সৃষ্টি হয়। তখন সৃষ্ট ফাটল বরাবর ভূগর্ভের গলিত আগ্নেয়পদার্থ বা লাভা উপরে উঠে এসে ফলক সীমান্তের খালি জায়গায় সঞ্চিত হয়।  দীর্ঘ দিন আগ্নেয়পদার্থ বা লাভা সঞ্চিত হয়ে ফলকের সীমান্ত বরাবর মহাসাগরীয় শৈলশিরা গড়ে উঠে। যেমন- আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশীয় প্লেট বা ফলকের সম্প্রসারণ গতির ফলে আটলান্টিক মহাসাগরের শৈলশিরা সৃষ্টি হয়েছে। 

প্লেট বা ফলকের সংকোচন গতি/ অভিসারী

(খ) সংকোচন গতি/ অভিসারী (Compressional Movement): দূরবর্তী ২টি ফলক (plates) যখন একে অপরের দিকে একই সীমারেখা বরাবর অগ্রসর হয়, তখন সে অবস্থাটিকে প্লেট বা ফলকের সংকোচন গতি/ অভিসারী বলে। পাহাড়-পর্বত সৃষ্টিতে ফলকের সংকোচন গতির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি থাকে। ফলকসমূহের সকোচন/ অভিসারণের অনুসারে সংকোচন গতিকে (১) মহাদেশীয়-মহাদেশীয়, (২) মহাদেশীয়-মহাসাগরীয় এবং (৩) মহাসাগরীয়-মহাদেশীয় নামে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ – একে অপরের দিকে অগ্রসরমান ২টি ফলকের মধ্যে একটি মহাসাগরীয় এবং অপরটি মহাদেশীয় হলে স্বাভাবিকভাবে মহাসাগরীয় ফলকটি মহাদেশীয় ফলকের নিচে নিমজ্জিত হয়ে যায়। মহাসাগরীয় ফলকটি ধীরে ধীরে নিচের দিকে নিমজ্জিত হয়ে গুরুমন্ডলের উত্তপ্ত পদার্থের মধ্যে প্রবেশ করে। এরূপ প্রক্রিয়ার ফলে ফলক ২টির সীমান্ত বরাবর ব্যাপক মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়ে থাকে। এ সময় ভূগর্ভ থেকে প্রচুর গলিত আগ্নেয় পদার্থ বা লাভা উপরে বেরিয়ে এসে আগ্নেয় পাহাড় বা পর্বতের সৃষ্টি করতে পারে। ব্যাপক সম্মুখ চাপের ফলে মহাদেশীয় ফলকের সামনের অংশ কুঁকড়ে ভঙ্গিল পর্বতের সৃষ্টি করে। আবার দেখা যায় যে, সংকোচন গতির ফলে মহাসাগরীয় ফলকটি নিমজ্জিত না হয়ে মহাদেশীয় ফলকের উপরে উঠে আসে।  

ফলকের পার্শ্বীয় গতি, প্লেটের পার্শ্বীয় গতি

(গ) পার্শ্বীয় গতি/ পাশাপাশি (Lateral Movement): পাশাপাশি অবস্থিত ২টি ফলক যখন একটি অপরটির পার্শ্ব বরাবর বিপরীত দিকে অগ্রসর হয়, তখন সে অবস্থাটিকে প্লেট বা ফলকের পার্শ্বীয় গতি বলে। এরূপ অবস্থায় ফলক ২টির  সীমান্ত বরাবর ভাঁজ, ফাটল ও চ্যুতির সৃষ্টি হতে পারে। এরূপ প্রক্রিয়ার ফলে ফলক ২টির সীমান্ত বরাবর ব্যাপক মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়ে থাকে। যেমন- ফলকের পার্শ্বীয় গতির ফলে নিউজিল্যান্ডের আলপাই চ্যুতির সৃষ্টি হয়েছে। [মো: শাহীন আলম]


সহায়িকা:
১. আরিফুর রহমান, মোহাম্মদ, (২০১৭-১৮), প্রাকৃতিক ভূগোল, কবির পাবলিকেশন্স, ঢাকা,।
২। বাকী, আবদুল, (২০১৩), ভুবনকোষ, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা।
৩। Singh, Savindra, (2009), Physical Geography, Prayag Pustak Bhawan, Allahabad.
৪। আবুল মাহমুদ, কাজী, (২০০৩), ভূগোল কম্প্রিহেনসিভ, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা।
৫। Types of Plate Boundaries


Map Source: Evidence of Plate Motions


 

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *