মাটির গঠন নির্ণয়ের সহজ উপায় | Soil Texture
মাটির গঠন [Soil Texture] বলতে মাটিতে বিদ্যমান কণাসমূহের (particles) আপেক্ষিক স্থূলতা বা সুক্ষ্মতাকে বুঝায়। মাটির গঠনকে আবার মৃত্তিকার গঠন বা গ্রন্থন বা বুনন বা বুনটও বলা হয়। মাটির গঠিত কণার আকার বা আয়তনের উপরে মাটির ভৌত গুণাবলী বা উর্বরতা (fertility) বহুলাংশে নির্ভর করে। কোন কোন মাটির কণা খালি চোখে দেখা যায়, আবার কোনটি দেখা যায় না। কণার ব্যাসের উপরে ভিত্তি করে মাটির গঠনের শ্রেণী বিভাগ করা হয়। মাটির গঠনের মধ্যে এরূপ মূল কণা হল ৩টি। যেমন –
১. বেলে (sand), ২. পলি (silt) ও ৩. এটেল (clay) মাটি।
মাটির গঠনের শ্রেণী বিভাগে উল্লেখিত ৩টি কণা নিম্নে উল্লেখিত অনুপাত বা শতকরার হিসেবে থাকতে দেখা যায়।
বালি (%) | পলি (%) | এটেল/কাদা (%) | গঠন বা বুনট শ্রেণী |
৮৮ – ১০০ | ০৩ – ০৭ | ০০ – ০৮ | বেলে মাটি |
০০ – ৫০ | ৫০ – ১০০ | ০০ – ২৬ | পলি মাটি |
০০ – ৬৩ | ০০ – ২৫ | ৩১ – ১০০ | এটেল মাটি |
উপর্যুক্ত বেলে, পলি ও এটেল কণার সংমিশ্রণে আরও কিছু মাটির গঠন বা বুনট শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। এগুলো হল- পলি এটেল, বেলে এটেল, দোঁ-আশ, এটেল দোঁ-আশ, পলি দোঁ-আশ, বেলে দোঁ-আশ, পলি এটেল দোঁ-আশ এবং বেলে এটেল দোঁ-আশ। মাটির এসব গঠন বা বুনট শ্রেণীতে বেলে, পলি ও এটেল কণার উপস্থিতির অনুপাত বা শতকরার হিসেবসহ নিম্নে তালিকা আকারে তুলে ধরা হল।
বালি (%) | পলি (%) | এটেল/কাদা (%) | গঠন বা বুনট শ্রেণী |
০০- ৩৪ | ২৫ – ৬০ | ৪০ – ৭৫ | পলিবিশিষ্ট এটেল মাটি |
৪৫ – ৬৫ | ০০ – ২০ | ৩৪ – ৪০ | বেলেবিশিষ্ট এটেল মাটি |
৫০ – ৭৬ | ১০ – ২৫ | ১২ – ২৬ | দোঁ-আশ মাটি |
২০ – ৪৫ | ১৫ – ৫৩ | ২৭ – ৪০ | এটেল দোঁ-আশ মাটি |
২৫ – ৭৪ | ২৫ – ৫০ | ০০ – ২৬ | পলি দোঁ-আশ মাটি |
৭০ – ৯২ | ০০ – ১২ | ০৮ – ২৯ | বেলে দোঁ-আশ মাটি |
০০ – ২০ | ৪০ – ৭৩ | ২৭ – ৪০ | পলি এটেল দোঁ-আশ মাটি |
৬৩ – ৮৩ | ০০ – ১০ | ১৭ – ৩০ | বেলে এটেল দোঁ-আশ মাটি |

মাটির গঠনে বা বুনটে (soil texture) মিশ্রিত বেলে (বালি), পলি ও এটেল (কাদা) কণার উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য প্রচলিত কিছু উপায় বা পদ্ধতি রয়েছে। এগুলো হল-
১। অনুভব পদ্ধতি (feeling method): এ পদ্ধতিতে মাটি নমুনা (sample) হাতে নিয়ে মাটির গঠন বা বুনট (soil texture) পরীক্ষা করা হয়। অনুভব পদ্ধতির মধ্যেও কতিপয় প্রচলিত পদ্ধতি রয়েছে। এগুলো হল-
১.১. ডান হাতের তালুতে এক চিমটি আর্দ্র মাটি নিয়ে বাম হাতের তর্জনী আঙ্গুলি দিয়ে তাতে ধীরে ধীরে ঘর্ষণ করলে-
ক. যদি শক্ত কণার (gritty) মত অনুভব হয়, তাহলে বেলে মাটি; এবং
খ. যদি শক্ত কণার (gritty) মত অনুভব না হয়, তাহলে এটেলযুক্ত পলি বা পলি মাটি।

১.২. হাতের তালুতে রেখে মাটিতে ধীরে ধীরে এবং স্বল্প পরিমাণে পানি দেই। মাটিকে বলে রূপান্তরের চেষ্টা করি। বলে রূপান্তরিত আর্দ্র মাটির পৃষ্ঠদেশ উজ্জ্বল (glisten) হয়। এবার বলটিকে বুড়ো আঙ্গুলি ও তর্জুনী আঙ্গুলি দিয়ে চেপে ফিতার মত রূপান্তরের চেষ্টা করি। এবার-
ক) যদি ০ বা ০.৫ সে.মি. এর কম দীর্ঘ হয়, তাহলে মোটা বুনট বা কাঁকর;
খ) যদি ৫.০ – ৭.০ সে.মি. দীর্ঘ হয়, তাহলে এটেল/কাদা মাটি;
গ) যদি ১.৫ – ৩.০ সে.মি. দীর্ঘ হয়, তাহলে পলি মাটি; এবং
ঘ) যদি ০.৫ – ১.০ সে.মি. দীর্ঘ হয়, তাহলে বেলে মাটি।

তবে অনুভব পদ্ধতিতে মাটিতে বেলে, পলি ও এটেল কণার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়, তবে সঠিক অনুপাত বা শতকরার পরিমাণ নির্ণয় করা যায় না।
১.৩. নিচের চিত্রে উল্লেখিত পদ্ধতিতেও মাটির গঠন বা বুনট পরীক্ষা করা যায়।

২। দ্রবণ পদ্ধতি (dilution Method): এ পদ্ধতিতে পানি ভর্তি স্বচ্ছ পাত্রে বা বিকারে নির্দিষ্ট পরিমাণ নমুনা মাটি দেয়া হয়। নমুনা মাটি পানির সাথে যথাযথভাবে দ্রবীভূত না হওয়া পর্যন্ত নাড়ানো হয়। এক পর্যায়ে নাড়ানো বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপরে স্বচ্ছ পাত্রে বা বিকারের তলায় মাটির কণাগুলো স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয় বা জমতে থাকে।
[আমরা জানি যে, তুলনামূলকভাবে যে কোন ভারী বস্তু সর্বপ্রথম নিচে নেমে এসে সঞ্চিত হয় বা জমে। আর মাটি গঠন উপাদানের মধ্যে তুলনামূলক বেশি ভারী হল বেলে কণা, মাঝারী ভারী হল পলি কণা এবং কম ভারী হল এটেল কণা।]
উপর্যুক্ত এ হিসেব অনুসারে স্বচ্ছ পাত্রে বা বিকারের তলায় সর্বপ্রথমে এবং খুব দ্রুতগতিতে বেলে কণা জমতে শুরু করবে। এরপরে এবং মাঝারী গতিতে পলি কণা। সর্বশেষে এবং খুবই ধীর গতিতে এটেল কণা জমতে থাকবে।
[প্রসঙ্গগত জেনে রাখার ভাল যে, যথাক্রমে বেলে, পলি ও এটেল মাটি নিচ থেকে উপরের দিকে স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়। আর নদীর তীরবর্তী ভূমির পার্শ্বচিত্র (section) সমীক্ষা করলে দেখা যায় যে, নিচ থেকে উপরের দিকে যথাক্রমে- বেলে, পলি ও এটেল মাটি স্তরে স্তরে বিরাজ করে। আবার উৎসমুখে বা উজানের দিকে নদীর কোথায় তীরবর্তী ভূমির পার্শ্বচিত্র (section) সমীক্ষা করলে দেখা যায় যে, নিচ থেকে উপরের দিকে যথাক্রমে- বড় পাথর খণ্ড, ছোট পাথরখণ্ড, নুড়ি পাথর, বেলে, পলি ও এটেল কণা স্তরে স্তরে বিরাজ করে।]
এবার স্বচ্ছ পাত্র বা বিকারটি ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, পাত্রটির তলা থেকে উপর পর্যন্ত দুই-ততোধিক স্তরে মাটির কণাগুলো সঞ্চিত হয়েছে। এখানে পাত্রটির তলার দিকের স্তরটি হল বেলে/বালি কণা, তার উপরে পলি কণা এবং সবচেয়ে উপরের পাতলা স্তরটি হল এটেল/কাদা কণার স্তর।

আমার চাইলে এ পদ্ধতিতে মাটির গঠনের মধ্যে বিদ্যমান বেলে, পলি ও এটেল কণার শতকরা বা অনুপাত নির্ণয় করতে পারি। এজন্য স্বচ্ছ পাত্রের মধ্যে সঞ্চিত মাটির স্তরগুলো স্কেল দিয়ে মেপে নিতে হয়। পাত্রের বাহির দেয়ালে স্কেল রেখে প্রতিটি স্তর পুরুত্ব আলাদা করে এবং সবগুলো স্তরের পুরুত্বের সমষ্টি মেপে নিতে হয়। যেমন-
২.১. প্রথম নমুনায় স্কেল দিয়ে মেপে বেলে ৮ সে.মি., পলি ১ সে.মি. এবং এটেল ১ সে.মি. পুরু পাওয়া যায়। তাহলে স্তরগুলোর পুরুত্বের সমষ্টি ১০ সে. মি.। অনুপাত হল- বেলে : পলি : এটেল = ৮ : ১ : ১। এখন মাটির শতকরা হিসেবে, বেলে ৮০%, পলি ১০% এবং এটেল ১০%। এ নমুনা মাটিকে আমরা বেলে মাটি বলতে পারি।
২.২. দ্বিতীয় নমুনায় স্কেল দিয়ে মেপে বেলে ৪ সে.মি., পলি ৩ সে.মি. এবং এটেল ৩ সে.মি. পুরু পাওয়া যায়। তাহলে স্তরগুলোর পুরুত্বের সমষ্টি ১০ সে. মি.। অনুপাত হল- বেলে : পলি : এটেল = ৪ : ৩ : ৩। এখন মাটির শতকরা হিসেবে, বেলে ৪০%, পলি ৩০% এবং এটেল ৩০%। এ নমুনা মাটিকে আমরা দোঁ-আশ মাটি বলতে পারি।
২.৩. তৃতীয় নমুনায় স্কেল দিয়ে মেপে বেলে ২ সে.মি., পলি ২ সে.মি. এবং এটেল ৬ সে.মি. পুরু পাওয়া যায়। তাহলে স্তরগুলোর পুরুত্বের সমষ্টি ১০ সে. মি.। অনুপাত হল- বেলে : পলি : এটেল = ২ : ২ : ৬। এখন মাটির শতকরা হিসেবে, বেলে ২০%, পলি ২০% এবং এটেল ৬০%। এ নমুনা মাটিকে আমরা এটেল মাটি বলতে পারি।
এ দ্রবণ পদ্ধতিতে মাটির গঠনে বা বুনটে মাটি কণার পরিমাণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ফলাফল ৭০-৮০% সঠিক পাওয়া যেতে পারে।
৩. ছাঁকন পদ্ধতি (sieving method): এ পদ্ধতিতে চালনির মাধ্যমে ছেঁকে মাটির কণাগুলোকে আলাদা করা হয়। এ পদ্ধতিটির প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে-
- প্রথমে নমুনা (sample) মাটির দলা বা খণ্ড থেকে দৃশ্যমান জৈবিক বস্তুগুলোকে অপসারণ করা হয়। মাটির দলা বা খণ্ডটিকে ভেঙ্গে গুড়া করা হয়।
- এর পরে নির্দিষ্ট পরিমাণ বা ৫০ গ্রাম পরিমাণ মাটি মেপে নেয়া হয়।
- একটি ছাঁকনি সেটের (sieving set) কতকগুলো ছিদ্রযুক্ত পাত্র (sieve) একের উপরে আরেকটি সারিবদ্ধভাবে উপর থেকে নিচের দিকে রাখা হয়। সবচেয়ে বড় ছিদ্রযুক্ত পাত্রটি সবার উপরে এবং ধারাবাহিকভাবে তুলনামূলক কম ছিদ্রযুক্ত পাত্রগুলো একের নিচে আরেকটি করে রাখা হয়। সবার নিচে থাকে সবচেয়ে চিকন ছিদ্রযুক্ত পাত্র বা ছাঁকনি। এর নিচে ছিদ্রহীন একটি পাত্র (pen) বসানো হয়।
- ছিদ্রযুক্ত পাত্র বা ছাঁকনিগুলো সাজানো হয়ে গেলে সবচেয়ে উপরের পাত্রটির মধ্যে মাটির গুড়া ছেড়ে দেয়া হয় এবং একটি ঢাকনা (lid) দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়।
- এরপরে সম্পূর্ণ ছাঁকনির সেটটি ১টি বৈদ্যুতিক কম্পন যন্ত্রের (shaker) উপরে রাখা হয় এবং কম্পন যন্ত্রটি প্রায় ১০মিনিটের জন্য চালু রাখা হয়।
- এবার বৈদ্যুতিক কম্পন যন্ত্র (shaker) থেকে ছাঁকনির সেটটি বের করা হয়। ছাঁকনির প্রতিটি পাত্র থেকে মাটি কণার অবশিষ্টাংশ (residue) বের করে আনা হয় এবং ওজন পরিমাপ করা হয়।
- ওজন করে প্রতিটি পাত্র থেকে নিম্নরূপ মাটির কণা পাওয়া গেল। যেমন-
S1/W1 (সবচেয়ে বড় বেলে কণা>২ মি.মি.) = ১০ গ্রাম, যা নমুনা মাটির ২০%;
S2/W2 (মোটা দানার বেলে কণা ) = ২০ গ্রাম, যা নমুনা মাটির ৪০%;
S3/W3 (মাঝারী দানার বেলে কণা) = ৮ গ্রাম, যা নমুনা মাটির ১৬%;
S4/W4 (চিকন দানার বেলে কণা) = ৫ গ্রাম, যা নমুনা মাটির ১০% এবং
S5/W5 (পলি ও এটেল/কাদা মাটির কণা) = ৭ গ্রাম, যা নমুনা মাটির ১৪% পাওয়া যায়। [এখানে S = Sieve & W = Weigh]

[বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, শুকনো মাটি দিয়ে এ পদ্ধতিতে মাটির নমুনা পরীক্ষা করা হয় বলে পলি থেকে এটেল মাটিকে আলাদা করে শনাক্ত ও চিহ্নিত করা একটু কঠিন বলা যায়। তাই পলি ও এটেল একসাথে পরিমাপ করে দেখানো হয়েছে। এ পদ্ধতিতে মাটির নমুনা পরীক্ষা করলে ফলাফল ৮০-৯০% সঠিক হয়ে থাকে।
এছাড়াও ১৯২৭ সাল থেকে Bouyoucos Hydrometer Method এর মাধ্যমে মাটির গঠন কণার পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। Pipette Method, Particulate Organic Matter (POM) method প্রভৃতি মাটির গঠন বা বুনট নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।
ফসলের চাষাবাদ, বহুতলাবিশিষ্ট স্থাপনা নির্মাণ, নদীর বাঁধ নির্মাণ, উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, ভূমি সংশ্লিষ্ট গবেষণা, যেকোন প্রকারের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ, প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও খনন প্রভৃতি বহুবিদ কাজের জন্য মাটির গঠন বা বুনট (soil texture) জানার প্রয়োজন হয়।
সহায়িকা:
- Soil Texture Estimating Hand
- Formation of a Bolus and Ribbon to Determine Soil Texture
- The soil Texture Pyramid
লেখক: মো: শাহীন আলম।