বাংলার প্রাচীন জনপদ: সমতট-পট্টিকেরা-কুমিল্লা

প্ৰাচীন যুগে ভারত উপমহাদেশে বাংলা নামে কোন অখণ্ড দেশ বা জনপদ ছিল না। তখন বাংলা ভূ-খণ্ডের বিভিন্ন অংশ জুড়ে বঙ্গ, পুণ্ড্ৰ, গৌড়, হরিকেল, সমতট, বরেন্দ্ৰ, রাঢ়, তাম্রলিপ্ত, প্রভৃতি নামক প্ৰায় ১৬টির মত বসতিতে (জনপদে) বিভক্ত ছিল। প্রাচীন এসব জনবসতির নির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ণয় করা কঠিন। এ প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় হিসেবে বিভিন্ন তথ্যসূত্র পর্যালোচনা করে সমতট জনপদের ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

সমুদ্রগুপ্তের (আনুমানিক খ্রি. ৩৩৫ – ৩৮০) এলাহাবাদ স্তম্ভলিপিতে গুপ্ত রাজ্যের আনুগত্যাধীন সীমান্তবর্তী রাজ্য হিসেবে ‘সমতট’ নামে একটি রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং (খ্রি. ৬৩৮ – ৬৩৯) সম-মো-তটা (সমতট) ভ্রমণ করে তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে সে রাজ্যে রাজত্বকারী একটি ব্রাহ্মণ ‘ভট্ট’ বংশের উল্লেখ করেছেন। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘সমতট’ নামের অর্থ (সম = সমতল + তট = সাগর উপকূলীয় ভূমি) সাগর উপকূলীয় সমতল ভূমি। সূতরাং বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ধরে বিস্তৃত গোটা সমতল অঞ্চলটিই সে কালে সমতট নামে পরিচিত ছিল বলে গণ্য করা যায়।

সপ্তম শতাব্দীতে ফুয়ান চুয়াং নামক আরও একজন চৈনিক পরিব্রাজক সমতটে এসেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর বিবরণী অনুযায়ী, সমতটের কেন্দ্র শহরের পরিধি ছিল ২০ লি (৫.৬ কিলোমিটার)। বৌদ্ধ সংস্কৃতির অবস্থান সম্পর্কে চুয়াং-এর বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, তিনি কুমিল্লার লালমাই অঞ্চলে বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রেই এসেছিলেন। সাম্প্ৰতিককালে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে এ বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বিস্তারিত চিত্র উন্মোচিত করা সম্ভব হয়েছে।

বর্তমান কুমিল্লা শহরের প্রায় ২৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত কৈলান গ্রামে আবিস্কৃত শ্রী ধারণ রাতের তাম্রলিপিতে ‘সমতটেশ্বর’ নামক রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ছিল ‘ক্ষীরোদা’ নদীর তীরবর্তী ‘দেবপর্বত’খড়গ শাসন পরবর্তী যুগে কুমিল্লা অঞ্চলে শাসন করে ‘দেব’ রাজবংশ এবং তাঁদের লিপিতেও ক্ষীরোদা তীরবর্তী দেবপর্বতের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। ‘দেবপর্বত’ লালমাই পাহাড়ের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ছিল। আর ক্ষীরোদা নদী সম্ভবত নিকটবর্তী মরা নদী ‘ক্ষীরা’, যার খাতের কিছু চিহ্ন এখনও বিদ্যমান।

মুর পর্যটক মরক্কোর অধিবাসী ইবনে বতুতার “কিতাবুল রেহেলার” বর্ণনা থেকে জানা যায়, তাঁর ভ্রমণকালে (খ্রি. ১৩৪৫ – ১৩৪৬) পদ্মা নদী সুদকওয়ান > চট্টগ্রামের কাছাকাছি সাগরের সাথে মিলিত ছিল।

খ্রিস্টীয় পনের শতকের চৈনিক পরিব্রাজক মাহুয়ানও তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে “চেত-তি-গা” চট্টগ্রাম থেকে সোনারগাঁও পর্যন্ত নৌ যোগাযোগের উল্লেখ করেছেন।

আবার খ্রিস্টীয় ষোল শতকের ঐতিহাসিক আবুল ফজলের বর্ণনা থেকে এটা এক প্রকার স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সে কালে পদ্মা নদী চট্টগ্রামের অদূরে সাগরের সাথে মিলিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, আবুল ফজল কখনও বাংলায় আসেননি। তবে তাঁর এ বর্ণনার সাথে ইবনে বতুতার মিল পাওয়া যায়।

খ্রিস্টীয় সতের শতকে ফরাসি পর্যটক ট্যাভার নিয়ার লিখেছেন, তাঁর ভ্রমণকালে পদ্মা নদী দৌলতদিয়া ঘাটের কাছাকাছি মানিকগঞ্জে প্রবেশ করেছিল।

বাংলার প্রাচীন বসতি

আবার রেনেলের মানচিত্রে (খ্রি. ১৭৭৮) দেখা যায়, প্রথমে পদ্মা নদী নতুন ব্রহ্মপুত্র > যমুনার সাথে মিলিত হয়েছে। এর পরে শাখা-প্রশাখাসহ এ নদীটি চাঁদপুর ছাড়িয়ে সাগরের দিকে বহমান। আর এসব সূত্র প্রমাণ করে, সতের শতকের কিছু আগ পর্যন্ত কুমিল্লাসহ নোয়াখালী বিস্তীর্ণ অঞ্চল দিয়ে নৌপথে চট্টগ্রাম যাওয়ার কোন সুব্যবস্থা ছিল না। তাই মেঘনা ধরে সমুদ্র হয়ে চট্টগ্রাম যেতে হতো। আর সে অঞ্চলটিই অতীতে সমতট নামে পরিচিত ছিল। আরও প্রমাণিত হয়, সমতটের/কুমিল্লার (?) পূর্ব পাশ দিয়ে অতীত থেকে খ্রিস্টীয় চৌদ্দ শতক পর্যন্ত কোন একটি নদী বহতা ছিল, যার মাধ্যমে সোনাগাঁও থেকে চট্টগ্রাম যাতায়ত সম্ভব ছিল। সময়ের পরিক্রমায় এসে ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে সমতট অঞ্চলের বর্তমান এ জেলাটির নাম বদলে ‘কুমিল্লা’ নাম রাখা হয়েছে।

সমতটের সাথে সম্পর্কযুক্ত আরও একটি প্রাচীন ভৌগোলিক নাম হল পট্টিকেরা। ইতোমধ্যে ’পটিকের’ নাম অঙ্কিত কিছু মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ অনুমান করেন, কুমিল্লার পট্টিকেরা পরগনা থেকেই এসব মুদ্রা প্রকাশিত হয়েছিল। ময়নামতির চারপত্র মুড়ায় আবিষ্কৃত লড়হ চন্দ্রের তাম্রলিপিতে সমতট অঞ্চলের পট্টিকেরকে ভূমিদান এবং পট্টিকেরকে শ্রী লড়হ মাধব ভট্টারকের মূর্তির উল্লেখ রয়েছে। ১২১৯ – ১২২০ খ্রিস্টাব্দের হরিকেল দেবের তাম্রলিপিতে পট্টিকের শহরে বৌদ্ধ বিহারের জন্য ভূমিদানের কথা রয়েছে। মুঘল আমলের রাজস্ব তালিকায় কুমিল্লার একটি পরগনার নাম পটিকরা বা পাইটকারা পাওয়া যায়। প্রাচীন পট্টিকেরই সম্ভবত কুমিল্লার এ পরগনা। পটিকের শহর এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের উত্তর প্রান্তের পূর্বদিকে পটিকের শহরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। [মো: শাহীন আলম]


১। হোসেন, মোহা: মোশাররফ এবং দেওয়ান, তোফায়েল আহমেদ, ময়নামতি-লালমাই, পৃষ্ঠা- ১৭।
২। বাকী, আবদুল, ভুবনকোষ, ২০১৩, ঢাকা: সুজনেষু প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ২৮১-২৮৩।


Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *