বিপন্ন নদী এবং প্রবল বন্যায় বিপদগ্রস্ত মানুষ
‘বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ’, আমরা সকলেই এ বাক্যটির সাথে খুবই পরিচিত। সাধারণত, নদী যে দেশের মাতা বা মায়ের মত সে দেশটিকেই নদীমাতৃক দেশ বলা হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৭০০ টিরও অধিক নদ-নদী জালের মত এদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এসব নদ-নদীর অধিকাংশের উৎসস্থল বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম, উত্তর, ও উত্তর-পূর্ব দিকে। এ দেশের উত্তরাঞ্চলের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণাঞ্চলের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নদ-নদীগুলো ক্রমাগত প্রবাহিত রয়েছে।
এ নদ-নদীগুলোর তীরে আমাদের দেশের প্রাচীন নগর সভ্যতা থেকে শুরু করে বর্তমানের গ্রাম, গঞ্জ, নগর ও মহানগরগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। জীবন জীবিকার জন্য উপযুক্ত স্থান ও খুবই উপকারী বলে এসব নদ-নদীর তীরে মানুষ ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে এবং যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। নদ-নদীর এত আধিক্য এবং এসব নদ-নদী মানুষের অপরিসীম উপকারে আসে বলেই হয়তো আমাদের বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

আবার এ নদ-নদীগুলো যখন দুই তীরের বিশাল এলাকা নিমজ্জিত হয়ে বন্যা অবস্থার সৃষ্টি করে, তখন আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা কি কখনও চিন্তা করেছি, নদী কেন আশির্বাদ থেকে অভিশাপ হয়ে যায়? যে নদ-নদীগুলো কিনা আমাদের অনেক উপকার করে, সে নদ-নদীগুলো এখন আমাদের বিপদের কারণ।
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১০-১৬টি জেলা, বিশেষ করে পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নওগাঁ, বগুড়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, শেরপুর এবং সুনামগঞ্জের কম বেশি এলাকা, এমন কি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর কম বেশি এলাকা প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয়। উল্লেখ্য যে, এসব জেলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে প্রায় ১০ – ৩০ মিটার উচুঁ, কোথাও কোথাও এর চেয়ে বেশি উঁচু। তা সত্ত্বেও উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি ও বৃষ্টির পানি একত্রে এসব জেলায় প্রবল বন্যা অবস্থার সৃষ্টি করছে। এ বন্যা প্লাবিত এলাকার ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, ঘাঘট, করতোয়া, বাঙ্গালী, আত্রাই, পুনর্ভবা, নাগর, তালমা, বংশী, কংস, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, গোমতী, ফেনী, প্রভৃতি মাতৃতুল্য বিখ্যাত নদ-নদী কী এদের আদি রূপ যৌবন ধরে রাখতে পেরেছে? নিশ্চয়ই না।
নদীবাহিত পলি ও বালু জমে এ নদ-নদীগুলো ইতোমধ্যে গভীরতা হারিয়েছে। অসংখ্য বালু চরবিশিষ্ট যমুনা, তিস্তা, ধরলা, সুরমা, কুশিয়ারা ও গোমতী নদী ব্যতিত অধিকাংশ নদীর গড় প্রশস্ততা কমে প্রায় ৩০ – ১২০ মিটারের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে আমাদের প্রয়োজনেই এসব নদ-নদীর দুই তীর দখল করে অপরিকল্পলিতভাবে ঘর-বাড়ি ও রাস্তাঘাট নির্মাণ; নগরায়ন, চাষাবাদ, প্রভৃতি কাজ করেছি। সরেজমিনে পরিদর্শন করলে দেখা যায় যে, কোথাও কোথাও এসব নদ-নদীর মাঝে বাঁধ (dem) দিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহকেও রোধ করা হয়েছে। এখন এসব নদ-নদী এত সরু এবং অগভীর হয়েছে যে, সময় মত বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে আগের মত বেশি পরিমাণে পানির ভার বহন করতে পারে না।
মৃত ও মৃতপ্রায় এসব নদ-নদী পানির ভার বহন করতে না পেড়ে দুই তীরের বিশাল এলাকাকে প্লাবিত করছে। দীর্ঘদিন যাবৎ অজ্ঞতার বসে কিংবা ইচ্ছা করে নির্বিচারে আমরা এ নদ-নদীগুলোকে শাসন এবং শোষণ করেছি। প্রতিবছর বন্যায় নিমজ্জিত হয়ে হয়তো আমাদেরকে তারই ফল ভোগ করতে হচ্ছে। এখন উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি ও বৃষ্টির পানি একত্রে উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের, এমন কি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলার মানুষের আবাস ভূমি, আবাদী জমি, গ্রাম ও শহরের উপর দিয়ে প্রায় ১.৫ থেকে ৩.০ মিটার উচুঁ হয়ে প্রবাহিত হয়। যা প্রায় ৭দিন থেকে মাসব্যাপী জলাবদ্ধ অবস্থায় থাকে।

বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল, বিশেষ করে পদ্মা নদীর তীরবর্তী জেলাগুলোতে বন্যার ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। বিশেষ করে, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, কুষ্টিয়া, নড়াইল, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, প্রভৃতি জেলার নিম্নাঞ্চল বর্ষা মৌসুমে বন্যায় প্লাবিত হয়। তবে এখানে বন্যার তীব্রতা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের, এমন কি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলার মত এত বেশি নয়। এসব জেলার নিম্নাঞ্চলসমূহ প্রায় ১.০ থেকে ১.৫ মিটার উচুঁ মাঝারি মাত্রার বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। যা প্রায় ২/৩ থেকে ৭ দিনব্যাপী জলাবদ্ধ অবস্থায় থাকে।
বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোতে অবস্থিত পদ্মা, মধুমতি, গড়াই, আড়িয়াল খাঁ, মাথাভাঙ্গা, নবগঙ্গা, কুমার, প্রভৃতি বিখ্যাত নদীর রূপ যৌবন কিছুটা লোপ পেয়েছে। প্রায় ১.৫ থেকে ৫ কিলোমিটার প্রশস্ততাবিশিষ্ট পদ্মা নদীর বুকের ব্যাপক এলাকা জুড়ে জেগে উঠেছে বালু চর। এছাড়া এখানকার বাকি নদীগুলোর গভীরতা কমে যাওয়ার সাথে সাথে প্রশস্ততা হারিয়ে প্রায় ২০০ – ৩৫০ মিটারের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। নদীবাহিত পলি ও বালু জমে এবং মানুষের অবৈধ দখল, নির্বিচারে আবাসন, চাষাবাদ, নগরায়ন, প্রভৃতির কারণে এসব নদী দিন দিন গভীরতা ও প্রশস্ততা হারাচ্ছে এবং কমে আসছে পানি নিষ্কাশনের পরিমাণ।

এবার আমরা যদি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, নোয়াখালী, ও লক্ষ্মীপুর জেলার দিকে তাঁকাই তাহলে বন্যার আরও ভিন্ন চিত্র দেখি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে প্রায় ১.৫ – ৩.০ মিটার উচুঁ দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো উত্তর-পশ্চিম, উত্তর-পূর্ব এবং মধ্যাঞ্চলের, এমন কি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর মত ব্যাপক এলাকা বর্ষা মৌসুমে পানিতে প্লাবিত হয় না। কারণ হিসেবে বলতে পারি, এসব জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা, শাহবাজপুর চ্যানেল, হাতিয়া চ্যানেল, তেতুলিয়া, কীর্তণখোলা, সন্ধ্যা, কচা, পায়রা, কারখানা, বিষখালী, বলেশ্বর, রূপসা, ভৈরব, প্রভৃতি অসংখ্য নদী এখনও তাদের রূপ যৌবন ধরে রেখেছে।
অর্থাৎ এ নদীগুলোর গভীরতা ও প্রশস্ততা অনেক বেশি। এখানকার এ নদীগুলো গড়ে প্রায় ৫০০ মিটার থেকে ৩/৫ কিলোমিটার প্রশস্ত। ফলে উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি, জোয়ারের পানি এবং অতিবৃষ্টির পানি অতিদ্রুত নিষ্কাশন করতে পারে। তবে এসব জেলায় যে চিত্র দেখা যায়, তাহল- ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস এবং নদীর তীরবর্তী নিচু এলাকায় ভরা জোয়ারের সময় পানি উঠা নামা করা। তবে এখানে উত্তর-পশ্চিম, উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মত বর্ষা মৌসুমে বন্যাজনিত দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় না।
বাংলাদেশের প্রবল বন্যার জন্য আমরা হয়তো বিভিন্ন জন বিভিন্ন কারণ ব্যাখ্যা করবে। যেমন- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব, অতিবৃষ্টি, আকস্মিক পাহাড়ি ঢল, আবার কেউবা বলবেন অপ্রতুল নিষ্কাশন ব্যবস্থা বা পর্যাপ্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব প্রভৃতি। বন্যার কারণ হিসেবে এসব ব্যাখ্যাই ক্ষেত্রবিশেষ যুক্তিযুক্ত।
তবে বন্যাবস্থার জন্য অন্যান্য কারণ যাই থাকুক, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর বর্তমান প্রবাহপথ, গভীরতা ও প্রশস্ততার চিত্র বিচার করে বর্তমান বন্যা ও জলাবদ্ধতার জন্য এদেশের উত্তরাঞ্চলের, এমন কি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যাপ্রবণ জেলাগুলোর নদ-নদী ও খালগুলোর অপ্রতুল নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে দায়ী করবো। আমার যুক্তির সাথে একমত হওয়ার জন্য আপনাদেরকে সরেজমিনে উত্তরাঞ্চলের, এমন কি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো পরিদর্শন করার প্রয়োজন নেই। ঘরে বসে কম্পিউটার কিংবা মোবাইলে গিয়ে গুগল মানচিত্রে বাংলাদেশের নদীগুলো সার্চ করে দেখুন। দেখবেন যে, উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের পদ্মা ও মেঘনা এবং উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা, ও গোমতী নদী ছাড়া প্রায় ৮০ – ৯০% নদ-নদী খুবই সরু ও অগভীর (প্রায় ১০-৩০ মিটার গভীর)। আবার যে সব নদ-নদী এখনও পর্যন্ত নাব্যতা নিয়ে টিকে রয়েছে, সে সব নদ-নদীও এখন বিপন্নপ্রায় বলা যায়।
নদীকে মানব দেহের রক্তনালীর (vein) সাথে তুলনা করা যায়। নদী হলো যে কোনো দেশের রক্তনালীর মতোই। কোলেস্টেরল জমে রক্তনালীর প্রবাহপথ সংকোচিত বা বন্ধ হলে মানুষের শরীরের যেমন প্রতিক্রিয়া হয় (স্ট্রোকসহ রক্তনালী ছিড়ে গিয়ে শরীরের অভ্যন্তরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ), ঠিক নদীপথ সংকোচিত বা বন্ধ হলে যে কোনো দেশের অভ্যন্তরে তেমনি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। আসুন টেকসই উন্নয়নের কথা চিন্তা করে, আমরা সকলে এখনই নদী রক্ষায় আওয়াজ তুলি। তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো আকস্মিক বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের আর নাও দেখতে হতে পারে।
গুগল মানচিত্রে বাংলাদেশের নদ-নদীর বর্তমান চিত্র দেখুন।
এত কথা লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো, একটা বার্তা দেয়া, যে সব নদ-নদীকে ঘিরে বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিখ্যাত প্রাচীন ও বর্তমান গ্রামীণ ও নগর সভ্যতাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেসব নদ-নদীকে বিপন্নতার হাত থেকে রক্ষা করা এখন আমাদের সময়ের দাবি। আর তাহলেই আমাদের মাতৃতুল্য এ নদ-নদীগুলো আমাদের জন্য অভিশাপ নয়, আশির্বাদ হয়েই বেঁচে থাকবে অনন্তকালব্যাপী। বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে দোষারোপ বা কাঁদা ছোড়াছুড়ি নয়, বন্যার বিপদ থেকে মানুষ ও দেশকে রক্ষার জন্য নদীকেন্দ্রিক টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এবার আসুন আমরা সবাই বন্যা দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াই এবং সাহায্যের হাত বাড়াই। [মো. শাহীন আলম]
[মানচিত্র ও আলোকচিত্রসমূহ সংগৃহীত]
Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL
বিপন্ন নদী এবং প্রবল বন্যায় বিপদগ্রস্ত মানুষ