নদী পরিচিতি: নদী সম্পর্কিত কতিপয় পরিভাষা
নদী [River] বলতে সাধারণত উৎস অঞ্চল (উঁচু ভূমি, পাহাড়, পর্বত, হ্রদ, ঝর্ণা প্রভৃতি) থেকে উৎপন্ন হওয়ার পরে বিভিন্ন জনপদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অন্য কোন জলাশয়ে (সাগর/হৃদ) পতিত জলধারাকে বুঝায়। আবার অন্যভাবে বলা যায়, তুষার বা বরফ গলা পানি, বৃষ্টির পানি, হ্রদ বা ঝর্ণার পানি ভূমির ঢাল অনুসারে প্রবাহিত হয়ে স্বাভাবিক যে জলধারা বা পানির স্রোত সৃষ্টি করে তাকে নদী বলে । যেমন- বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা প্রভৃতি নদী। নদী পরিচিতি আলোচনায় বিশেষজ্ঞগণ প্রদত্ত নদীর নিম্নরূপ সংজ্ঞা তুলে ধরা হল।
মেরী মরিসাওয়া (Mary Morisawa) নদীর সংজ্ঞায় উল্লেখ করেন যে, ”A stream may be defined as a channelized flow of water.” অর্থাৎ একটি নদীকে একটি প্রবাহিত জলধারা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।
পানি বিজ্ঞানী জ্যাকি স্মিথ (Jackie Smith) নদীর সংজ্ঞায় উল্লেখ করেন যে, ”A large stream of fresh water flowing downhill within a channel to enter another river, or a lake, or sea.” অর্থাৎ নদী হল স্বাভাবিক খাতের মধ্য দিয়ে অন্য কোন নদী, বা হ্রদ, বা সমুদ্রে প্রবেশ করে নিম্নঢালের দিকে প্রবাহিত স্বাদু বা সুপেয় পানির বৃহৎ স্রোত ধারা।
উপনদী [Tributary] বলতে সাধারণত বিভিন্ন উৎস (উঁচু ভূমি, পাহাড়, পর্বত, হ্রদ, ঝর্ণা,নদী প্রভৃতি) থেকে উৎপন্ন সে সব ছোট ছোট নদীকে বুঝায়, যে সব নদী অন্য কোন প্রবাহিত বড় নদীতে পতিত হয়েছে বা পানি সরবরাহ করে। যেমন- বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের তিস্তা ও ধরলা নদী, যমুনা নদীর উপনদী। কারণ তিস্তা ও ধরলী নদী, যমুনা নদীতে পতিত হয়েছে এবং পানি সরবরাহ করে। এ ধরনের নদীকে অনেকে করদ নদীও বলে থাকে।
শাখা নদী [Distributary River] বলতে সাধারণত সে সব নদীকে বুঝায়, যে সব নদী কোন মূল নদী থেকে প্রবাহিত হয়ে অন্য কোন জলাশয় বিশেষ করে নদী বা সাগর বা হৃদে পতিত হয়েছে বা পানি সরবরাহ করে। যেমন – বাংলাদেশের ধলেশ্বরী নদী, যমুনা নদীর শাখা নদী। আবার এ ধলেশ্বরী নদী মেঘনা নদীর উপনদী। কারণ ধলেশ্বরী নদীর পানির উৎস হল যমুনা নদী এবং পতিত হয়েছে মেঘনা নদীতে।
নদী উৎস অঞ্চল [River Source Area] বলতে সাধারণত নদী যে অঞ্চলে উৎপত্তি হয়, সে অঞ্চলকে বুঝায়। যেমন – পাহাড়, পর্বত, হ্রদ, ঝর্ণা প্রভৃতি থেকে নদী উৎপত্তি হয়। সূতরাং পানির প্রবাহযুক্ত পাহাড়, পর্বত, হ্রদ, ঝর্ণা প্রভৃতি হতে পারে নদীর উৎস অঞ্চল।
নদীর গতিপথ [River Course] বলতে সাধারণত নদীর অগ্রসরমান পানির প্রবাহ পথকে বুঝায়। অর্থাৎ উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত নদীর পানি প্রবাহ ধারা।
নদী উপত্যকা [River Channel] বলতে সাধারণত উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত নদীর পানি প্রবাহের খাতকে বুঝায়। অর্থাৎ যে খাতের মধ্য দিয়ে নদীর পানি প্রবাহিত হয়, সে খাতকে নদী উপত্যকা বলে। নদীর উৎস অঞ্চলের উপত্যকাকে উচ্চ উপত্যকা (upper part) বলে। নদীর মোহনা অঞ্চলের উপত্যকাকে নিম্ন উপত্যকা (lower part) বলে।
নদী তল [River Bed] বলতে সাধারণত নদী উপত্যকার তলদেশকে বুঝায়। নদী তলকে আবার নদী গর্ভও বলা হয়ে থাকে।
নদী তীর [River Bank] বলতে সাধারণত নদী উপত্যকার উভয় পাড়কে বুঝায়। নদী তীরকে আবার নদী তটও বলা হয়ে থাকে।
নদী পাড় [Levee] বলতে সাধারণত নদীর এক পাশে কিংবা উভয় পাশে (তীরে) দৃশ্যমান ভূমিকে বুঝায়। দেখতে প্রায়ই উঁচু ভূমির বাঁধের মত বলে নদীর পাড়কে আবার প্রাকৃতিক বাঁধও (natural levee) বলা হয়। সাধারণত উভয় কূল প্লাবিত হলে নদী বাহিত পলি, কাঁকর সঞ্চিত হয়ে এ ধরনের প্রাকৃতিক বাঁধের সৃষ্টি হয়। কখনও কখনও এসব বাঁধের পিছনের দিকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ জলাবদ্ধতাকে স্থানীয়ভাবে হাওড় বা জলা (swamp) বলে।
নদী ব্যবস্থা [River System] বলতে সাধারণত কোন একটি মূল নদীসহ এর বিভিন্ন শাখা নদী ও উপনদীসমূহকে একত্রে বুঝায়। যেমন – বাংলাদেশের ১. ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী ব্যবস্থা, ২. গঙ্গা-পদ্মা নদী ব্যবস্থা, ৩. সুরমা-মেঘনা নদী ব্যবস্থা প্রভৃতি।
নদী অববাহিকা [River Basin] বলতে সাধারণত নদীর মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের কোন এলাকা বা অঞ্চলকে বুঝায়। অর্থাৎ মূল নদী এবং এর শাখা নদী ও উপনদীসমূহ নিয়ে গঠিত একটি নদী ব্যবস্থা যে অঞ্চলের জলরাশি নিষ্কাশন করে, সে অঞ্চলকে সংশ্লিষ্ট নদী ব্যবস্থার অববাহিকা বলা হয়। যেমন – বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী ব্যবস্থার অববাহিকা অঞ্চল হল নদী তীরবর্তী জেলা সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম এবং জামালপুর, টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জ।
নদী সঙ্গম [River Confluence] বলতে সাধারণত দুই বা ততোধিক নদীর মিলন স্থানকে বুঝায়। যেমন – বাংলাদেশে পদ্মা ও যমুনা নদী রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দের কাছে মিলিত হয়ে একটি নদী সঙ্গম সৃষ্টি করেছে।
নদী বহন ক্ষমতা [River Carrying Capacity] বলতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে নদীর পানি প্রবাহের দ্বারা যে কোন বস্তু কিংবা পলি বহন করার ক্ষমতাকে বুঝায়। আর ভূমির ঢাল যত বেশি থাকে, নদীর বহন ক্ষমতা তত বেশি থাকে।
নদীর বিবর্তন পর্যায় [Evolutionary Stage of a River] বলতে সাধাণত উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত কোন একটি নদীর গতি ও প্রবাহের পরিবর্তন বা বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়কে বুঝায়। নদীর বিবর্তনকে প্রধাণত ৩টি পর্যায় বা স্তরে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- ১. তারুণ্য পর্যায়, ২. পরিণত পর্যায় এবং ৩. বার্ধক্য পর্যায়। উৎসস্থল এবং তুলনামূলক উঁচু ভূমিভাগে নদীর তারুণ্য পর্যায় দেখা যায়। এ পর্যায়ে নদীর স্রোত প্রবাহ এবং গভীরতা খুব বেশি দেখা যায়। তুলনামূলক নিম্ন ভূমিরূপে এবং সমভূমিতে নদীর পরিণত পর্যায় দেখা যায়। এ পর্যায়ে নদী আরও প্রশস্ত হয় এবং আশেপাশে ভূমিক্ষয় হতে দেখা যায়। মোহনার কাছে সমভূমি এলাকাতে নদীর বার্ধক্য পর্যায় দেখা যায়। এ পর্যায়ে নদী স্রোতের গতি প্রায়শ: হারিয়ে ফেলে এবং গতিপথ সর্পিল আকার ধারণ করে।
নদী প্রপাত [River Rapid] বলতে সাধারণত নদীর প্রবাহ পথে সৃষ্ট প্রবল খরস্রোত অবস্থাকে বুঝায়। অর্থাৎ পার্বত্য অঞ্চলে কোমল ও কঠিন শিলা পাশাপাশি অবস্থান করে। পানি প্রবাহের ফলে কোমল শিলা দ্রুত ক্ষয়ে যায় এবং কঠিন শিলা প্রায় সিঁড়ির মত উপরে-নিচে ধাপে ধাপে অবস্থান করে। এ অবস্থায় নদীর পানি লাফিয়ে লাফিয়ে প্রবাহিত হয় এবং প্রবল খরস্রোতের সৃষ্টি করে। পার্বত্য অঞ্চলে নদী প্রবাহের এ দৃশ্যকে নদী প্রপাত বলা হয়।
নদী সোপান [River Terrace] বলতে সাধারণত পানি প্রবাহজনিত ক্ষয়কার্যের ফলে নদী উপত্যকায় সৃষ্ট প্রায় সিঁড়ির মত ধাপ (step) ভূমিরূপকে বুঝায়। অর্থাৎ সমভূমি এলাকায় নদীর মধ্যগতিতে ক্ষয় ক্রিয়ার ফলে নদী উপত্যকার উভয় পাশে ধাপ ধাপ (steps) ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। সাধারণত এ সোপানের উচ্চতা সমান হয় না। তবে নদী উপত্যকার উভয় পাশের সোপানের উচ্চতা সমান হলে, তাকে জোড়া সোপান (paired terrace) বলা হয়। সোপানের উচ্চতাগত ভিন্নতা হলে, তাকে বিজোড় সোপান (Non-paired terrace) বলা হয়।
নদীগ্রাস [River Capture] বলতে সাধারণত দুর্বল নদীর কিছু অংশ প্রবল/সবল নদীর অন্তর্ভূক্ত করাকে বুঝায়। অর্থাৎ দুটি নদী পাশাপাশি বা স্বল্প দূরত্বে প্রবাহিত হওয়ার সময় দুর্বল নদীর কিছু অংশ প্রবল নদীর আপন উপত্যকার অন্তর্ভূক্ত করে নেয়। আর এ অবস্থাটিকে নদী গ্রাস বলা হয়। নদী গ্রাসের ফলে দুর্বল নদীটি মূল স্রোতধারা থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ায় আগের পথে প্রবাহিত হয় না। বরং প্রবল নদীর সাথে মিশে প্রবাহিত হয়। নদী গ্রাসের এ প্রক্রিয়াটিকে নদীর শিরোচ্ছেদন (beheading of river) বলা হয়। এ প্রক্রিয়ায় বিচ্ছিন্ন নদীকে শিরোচ্ছেদিত নদী (beheaded river) বলা হয়।
নদী পরিলেখ [River Profile] বলতে সাধারণত নদীর গতি প্রবাহ প্রদর্শনের জন্য অঙ্কৃত পার্শ্বচিত্রকে বুঝায়। অর্থাৎ উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত নদীর গতি প্রবাহ প্রদর্শনের জন্য পার্শ্বচিত্র অঙ্কন করা হয়। [মো: শাহীন আলম]
সহায়িকা:
১. বাকী, আবদুল, (২০১৩), ভুবনকোষ, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা।
২. The water cycle and river terminology
৩. River profiles
৪. আরিফুর রহমান, মোহাম্মদ, (২০১৭-২০১৮), প্রাকৃতিক ভূগোল, কবির পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
Introduction of River: Some Technical Words related to river