আটলান্টিক মহাসাগরীয় স্রোত | Atlantic Ocean Currents
আটলান্টিক মহাসাগরীয় স্রোত [Atlantic Ocean Currents] বলতে মূলত আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবাহিত সমুদ্রস্রোতসমূহকে বুঝায়। আটলান্টিক মহাসাগর নামক এ বিশাল জলরাশিটি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ এবং ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের মাঝখানে অবস্থিত। নিরক্ষরেখার উত্তরাংশকে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর এবং দক্ষিণাংশকে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর বলা হয়। আটলান্টিক মহাসাগরীয় স্রোতসমূহ বর্ণনা করার সুবিধার্থে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরীয় স্রোত এবং উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরীয় স্রোত নামে দু’ভাগে বিভক্ত করে নিম্নে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হল।
ক. দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরীয় স্রোত [South Atlantic Ocean Currents]: নিরক্ষরেখা থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের দক্ষিণ অংশে যে সব সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়, সে সব সমুদ্রস্রোতকে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরীয় স্রোত বলা হয়। বিভিন্ন নাম ধারণ করে প্রবাহিত দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরীয় স্রোতসমূহ নিম্নে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হল।
ক.১. পশ্চিমা স্রোত [West Wind Current]: এ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের উত্তর পাশ দিয়ে পশ্চিমা বায়ু (প্রত্যায়ন বায়ু) পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। এ পশ্চিমা বায়ু কর্তৃক পরিচালিত হয়ে একটি শীতল স্রোত প্রশান্ত মহাসাগর থেকে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশ করে। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত এ স্রোতটিই পশ্চিমা স্রোত বা পশ্চিমা বায়ু স্রোত নামে পরিচিত। স্রোতটি ক্রমেই দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে গতিপথে দক্ষিণ আফ্রিকার মহীসোপানের উপর দিয়ে প্রবাহিত হবার সময় নিমজ্জিত স্থলভাগের সাথে বাঁধা প্রাপ্ত হয়। এরপরে এ স্রোতটির একটি ধারা বেঁকে আফ্রিকার পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। আর পশ্চিমা স্রোতের মূল ধারাটি পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে।
ক.২. বেঙ্গুয়েলা স্রোত [Benguela Current]: দক্ষিণ আফ্রিকার মহীসোপানের নিমজ্জিত স্থলভাগের সাথে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে পশ্চিমা স্রোতের একটি ধারা বেঁকে আফ্রিকার পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। পশ্চিমা স্রোত থেকে উৎপন্ন এ স্রোতধারাটি আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল দিয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হওয়ার সময় ‘বেঙ্গুয়েলা স্রোত’ নাম ধারণ করে। এ স্রোতটি দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে নিরক্ষীয় অঞ্চলে যেতে যেতে ক্রমেই উষ্ণ হতে থাকে। পরবর্তীতে এ স্রোতটি নিরক্ষীয় স্রোতধারার সাথে মিশে যায়।
ক.৩. দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত [South Equatorial Current]: দক্ষিণ-পূর্ব অয়ন বায়ু কর্তৃক পরিচালিত হয়ে একটি স্রোতধারা প্রথমে দক্ষিণ-পূর্ব থেকে উত্তর-পশ্চিমে এবং পরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে নিরক্ষরেখার দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়। নিরক্ষরেখার দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এ স্রোতটি দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত নামে পরিচিতি পায়। মূলত এটি একটি উষ্ণ সমুদ্রস্রোত। এ স্রোতটি ক্রমেই পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়ে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলের সেন্টারক অন্তরীপে বাঁধা পেয়ে ২টি স্রোতধারা বিভক্ত হয়। বিভক্ত স্রোতধারার একটি উত্তর দিকে বেঁকে উত্তর-পশ্চিম দিকে এবং অপরটি দক্ষিণ দিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়।
ক.৪. বাজিল স্রোত [Brazil Current]: দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের যে ধারাটি ব্রাজিলের সেন্টারক অন্তরীপের কাছ থেকে দক্ষিণ দিকে বেঁকে ব্রাজিলের পূর্ব উপকূল দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়, সে স্রোতধারাটিই ব্রাজিল স্রোত নামে পরিচিত। এটি একটি উষ্ণ সমুদ্রস্রোত হলেও ক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমেই শীতল হতে থাকে।
ক.৫. ফকল্যান্ড স্রোত [Falkland Current]: পশ্চিমা স্রোত থেকে একটি ক্ষুদ্র সমুদ্রস্রোত ধারা ফকল্যান্ড দ্বীপের কাছ দিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশ করে। শীতল এ স্রোতধারাটি দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব উপকূল ও ব্রাজিল স্রোতের মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে উত্তর দিকে কিছুদূর প্রবাহিত হয়। আর ক্ষুদ্র এ স্রোতধারাটিকে ‘ফকল্যান্ড স্রোত’ বলে।
খ. উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরীয় স্রোত [North Atlantic Ocean Currents]: নিরক্ষরেখা থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর অংশে যে সব সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়, সে সব সমুদ্রস্রোতকে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরীয় স্রোত বলা হয়। বিভিন্ন নাম ধারণ করে প্রবাহিত উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরীয় স্রোতসমূহ নিম্নে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হল।
খ.১. উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত [North Equatorial Current]: উত্তর-পূর্ব অয়ন বায়ু কর্তৃক পরিচালিত হয়ে একটি স্রোতধারা প্রথমে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল থেকে উত্তর-পশ্চিমে এবং পরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে নিরক্ষরেখার উত্তর পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়। নিরক্ষরেখার উত্তর পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এ স্রোতটি উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত নামে পরিচিতি পায়। মূলত এটি একটি উষ্ণ সমুদ্রস্রোত। এ স্রোতটি ক্রমেই পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়ে দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূল থেকে ২টি স্রোতধারা বিভক্ত হয়।
খ.২. উপসাগরীয় স্রোত [Gulf Stream]: দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের যে শাখাটি ব্রাজিলের সেন্টারক অন্তরীপের কাছ থেকে প্রবাহিত হয়ে নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব ও উত্তর উপকূল দিয়ে অগ্রসর হয়, সে শাখাটি ক্যারিবিয়ান সাগরে উত্তর নিরক্ষীয় স্রোতের শাখার সাথে মিলিত হয়। এ মিলিত উষ্ণ সমুদ্রস্রোতটি সেখান থেকে প্রবাহিত হয়ে মেক্সিকো উপসাগরে প্রবেশ করে। এ স্রোতটি গভীর অপ্রশ্রস্ত ফ্লোরিডা প্রণালীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উপসাগরীয় স্রোত নামে প্রবাহিত হয়। এরপরে উপসাগরীয় স্রোতধারাটি উত্তর নিরক্ষীয় স্রোতের অপর শাখার সাথে মিলিত হয়। এ মিলিত স্রোতধারা উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উত্তরে হ্যাটেরাস অন্তরীপ পর্যন্ত অগ্রসর হয়।
খ.৩. উত্তর আটলান্টিক প্রবাহ [North Atlantic Drift]: পৃথিবীর আবর্তন গতি ও ঐ অঞ্চলের বায়ুর প্রভাবে উপসাগরীয় স্রোতটি উত্তর আটলান্টিকের মধ্যভাগে তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়। উপসাগরীয় স্রোতের তিনটি শাখা থেকে যে শাখাটি প্রবাহিত হয়ে পশ্চিম ইউরােপীয় মূল ভূ-ভাগের দিকে অগ্রসর হয়, সে শাখাটি উত্তর আটলান্টিক প্রবাহ নামে পরিচিত। মূলত এটি একটি উষ্ণ সমুদ্রস্রোত।
খ.৪. নরওয়েজীয় স্রোত [Norwegian Current]: উত্তর আটলান্টিক প্রবাহের একটি শাখা উত্তর সাগর অতিক্রম করার পর নরওয়েজীয় স্রোত নামে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতটি স্ক্যানডিনেভিয়া উপকূলের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্যারেন্টস সাগরে প্রবেশ করে। সেখান থেকে আরও উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে স্পিটস বারজেন পর্যন্ত অগ্রসর হয়।
খ.৫. ক্যানারী স্রোত [Canary Current]: উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোত যে তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়, তার সবচেয়ে দক্ষিণ দিকের শাখাটি দক্ষিণ দিকে বেঁকে পর্তুগাল ও পশ্চিম আফ্রিকার পাশ দিয়ে ফেরেলের সূত্র অনুসারে দক্ষিণাবর্তে ঘুরে ক্যানারী স্রোত নামে দক্ষিণ-পশ্চিম ও পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়। এরপরে স্রোতটি প্রবাহিত হয়ে ক্রমে উত্তর নিরক্ষীয় স্রোতের সাথে মিলিত হয়।
খ.৬. গিনি স্রোত [Guianea Current]: পশ্চিম আফ্রিকার পার্শ্ববর্তী ভার্ট প্রণালী অতিক্রম করার পর ক্যানারী স্রোতের একটি শাখা গিনি স্রোত নামে দক্ষিণ-দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতধারাটি গ্রেইন, আইভরী ও শ্লেভ উপকূলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ক্যামেরুন উপকূল পর্যন্ত অগ্রসর হয়।
খ.৭. পশ্চিম গ্রীনল্যান্ড স্রোত [West Greenland Current]: মধ্য আটলান্টিকে বিভক্ত উপসাগরীয় স্রোতের তৃতীয় শাখাটি প্রথমে আইসল্যান্ডের দক্ষিণ পাশ দিয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। এরপরে এ স্রোতটি বেফিন দ্বীপ ও গ্রীনল্যান্ডের মধ্যবর্তী ডেভিস প্রণালীর মধ্যদিয়ে পশ্চিম গ্রীনল্যান্ড স্রোত নামে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়।
খ.৮. মেরু স্রোত [Polar Current]: উত্তর মহাসাগর থেকে কয়েকটি শীতল স্রোত দক্ষিণ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয় । এ স্রোতধারাটি প্রবাহিত হয়ে ক্রমশ বেশি বিস্তৃত অংশের দিকে অগ্রসর হতে হতে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়।
খ.৯. পূর্ব গ্রীনল্যান্ড স্রোত [East Greenland Current]: মেরু অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব বায়ুর প্রভাবে শীতল স্রোত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে গ্রীনল্যান্ডের পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়। প্রবাহিত এ স্রোতটিই মূলত পূর্ব গ্রীনল্যান্ড স্রোত নামে পরিচিত।
খ.১০. লাব্রাডার স্রোত [Labrador Current]: উত্তর মহাসাগর থেকে অপর একটি শীতল স্রোত দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে প্রথমে বেফিন উপসাগরে প্রবেশ করে। সেখান থেকে ডেভিস প্রণালীর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ দিকে উত্তর আমেরিকার লাব্রাডার উপদ্বীপের উত্তর প্রান্তে এসে শীতল পূর্ব গ্রীনল্যান্ড স্রোতের সাথে মিলিত হয়। এ মিলিত স্রোতধারাটি লাব্রাডার স্রোত নামে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়।
খ.১১. ইরমিনজের স্রোত [Irminous Current]: উত্তর মহাসাগর থেকে ইরমিনজের নামক একটি শীতল স্রোত আইসল্যান্ডের পূর্ব ও দক্ষিণ উপকূল দিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। উত্তর আটলান্টিক প্রবাহের উত্তর পাশে এসে স্রোতটি তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। এছাড়াও আটলান্টিক মহাসাগরে নিম্নে উল্লেখিত ২টি সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হতে দেখা যায়।
গ. নিরক্ষীয় বিপরীত স্রোত [Counter Equatorial Current]:: উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত ও দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের মধ্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ একটি স্রোতধারা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতটিকে নিরক্ষীয় বিপরীত স্রোত বা নিরক্ষীয় প্রতিস্রোত বলা হয়।
ঘ. নিরক্ষীয় অন্ত:স্রোত [Equatorial inflow]: প্রশান্ত মহাসাগরের ক্রোমওয়েল স্রোতের ন্যায় একটি সমুদ্রস্রোত আটলান্টিক মহাসাগরের নিরক্ষীয় অন্ত:স্রোত হিসেবে প্রবাহিত হয়। [মো: শাহীন আলম]
সহায়িকা:
১. রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, প্রাকৃতিক ভূগোল, ২০১৭-২০১৮, কবির পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
২. Singh, Savindra, Physical Geography, 2009, Prayag Pustak Bhawan, Allahabad.