জোয়ার-ভাঁটার শ্রেণীবিভাগ

সমুদ্রের পানি প্রতিদিন নিয়মিতভাবে দুই বার কোন একটি স্থানে ফুলে উঠাকে জোয়ার এবং অন্য স্থানে নেমে যাওয়াকে ভাঁটা বলে। জোযার-ভাঁটাকে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে ভিত্তি করে শ্রেণিবিভাগ করা যায়। চাঁদের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে জোয়ার-ভাঁটাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:

ক) মুখ্য জোয়ার (primary tide) এবং
খ) গৌণ জোয়ার (secondary tide)।
আবার, পানির উচ্চতার উপরে ভিত্তি করে জোয়ার-ভাঁটাকে আরও দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:
গ) ভরা কটাল (spring tide) এবং
ঘ) মরা কটাল (neap tide)। নিম্নে জোয়ার-ভাঁটার শ্রেণীগুলো পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হয়েছে।

tide-generating-force.gif

ক) মুখ্য জোয়ার (primary tide): পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে আবর্তনকালে পৃথিবীর যে অংশ চাঁদের ঠিক সামনে উপস্থিত হয়, সেখানে চাঁদের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি হয়। স্থলভাগের তুলনায় পানির উপর চাঁদের আকর্ষণ শক্তির কার্যকারিতা অনেক বেশি হয়ে থাকে। আর এ কারণে চারদিক থেকে পানিরাশি পানিভাগের ঐ আকর্ষণ স্থানের দিকে প্রবাহিত হয়। এর ফলে চাঁদের ঠিক সামনে পৃথিবীর নিকটবর্তী স্থানটির পানি ফুলে উঠে। এরূপে সৃষ্ট জোয়ারকে নিকটবর্তী জোয়ার (near side tide) জোয়ার বলে। এরূপ জোয়ারকে মুখ্য জোয়ার (primary tide) বা প্রত্যক্ষ জোয়ার (direct tide) বলে।

gravity-and-bulges.gif

খ) গৌণ জোয়ার (secondary tide): আবার পৃথিবীর যে অংশে চাঁদের আকর্ষণের ফলে মুখ্য জোয়ার হয়, এর বিপরীত দিকে অর্থাৎ প্রতিবাদ স্থানে পানির নিচে যে কঠিন স্থলভাগ রয়েছে, তা পৃথিবীর কেন্দ্রের সাথে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত থাকে। তার উপর চাঁদের আকর্ষণ কেন্দ্রস্থলে আকর্ষণের সমান। ফলে বিপরীত দিকের পানিভাগ অপেক্ষা স্থলভাগ চাঁদের দিকে অধিকতর আকৃষ্ট হয়। এ সময় বিপরীত দিকের পানিরাশির উপর পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব কমে যায়। তখন বিকর্ষণ শক্তির প্রভাবে চারপাশের পানিরাশি সে স্থানে প্রবাহিত হয়ে জোয়ারের সৃষ্টি করে। এ জোয়ারকে দূরবর্তী জোয়ার (far side tide) বলা হয়। এরূপ জোয়ারকে গৌণ জোয়ার (secondary tide) বা পরোক্ষ জোয়ার (indirect tide) বলে।

গ) ভরা কটাল (spring tide): জ্যোতির্বিদগণ মনে করেন, চাঁদ ও সূর্যের জোয়ার সংঘটিত করার ক্ষমতার অনুপাত ১১ : ৫। অমাবস্যার সময়ে সূর্য ও চাঁদ পর্যায়ক্রমে একই দিকে পৃথিবীর সাথে একই সরলরেখায় অবস্থান করে। আবার পূর্ণিমার সময় পৃথিবীর এক দিকে সূর্য ও অপর দিকে চাঁদ থাকে এবং একই সরলরেখায় অবস্থান করে। যার ফলে সূর্য ও চাঁদের আকর্ষণ শক্তি একই সাথে পৃথিবীর উপরে কার্যকরী হয়। দূরত্বের কারণে সূর্যের আকর্ষণ চাঁদের আকর্ষণের তুলনায় কম হলেও উভয়ের মিলিত আকর্ষণ পৃথিবীর উপরে প্রবল হয়। অমাবস্যার ও পূর্ণিমার দিন চাঁদের আকর্ষণে যে স্থানে মূখ্য ও গৌণ জোয়ার হয়, সূর্যের আকর্ষণেও সে স্থানে জোয়ার হয়। ঐ দুইদিন সূর্য ও চাঁদের শক্তির আকর্ষণের ফলে পৃথিবীর দুই দিকের পানি খুব বেশি ফুলে উঠে দুই দিকে জোয়ারের সৃষ্টি করে। এ দুই জোয়ারের মধ্যবর্তী সমকোণী অংশে ভাঁটার পানি খুব বেশি পরিমাণে নেমে যায়। এ কারণে অমাবস্যার ও পূর্ণিমার সময়ের জোয়ারকে ভরা জোয়ার বলা হয়। এরূপ জোয়ারকে ভরা কটাল বা তেজকটাল (spring tide) বলে।

lunar-and-solar-tides.gif

ঘ) মরা কটাল (neap tide): সপ্তমী ও অষ্টমী তিথিতে সূর্য ও চাঁদ সমসূত্রে বা একই সরলরেখায় অবস্থান না থেকে উভয়ে পৃথিবীর সাথে এক সমকোণে অবস্থান করে পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। এর ফলে সে সময় পৃথিবীর উপরে সূর্য ও চাঁদের আকর্ষণ আড়াআড়িভাবে কার্যকরী হয়। এ সময় চাঁদের আকর্ষণে চাঁদের দিকের পৃথিবীর অংশে ও এর বিপরীত দিকের অংশে জোয়ার এবং সূর্যের আকর্ষণে সূর্যের দিকের পৃথিবীর অংশে ও এর বিপরীত দিকে জোয়ার হওয়ার কথা। কিন্তু চাঁদের আকর্ষণ শক্তি বেশি হওয়ায় চাঁদের আকর্ষণে চাঁদের দিকের পৃথিবীর অংশে ও এর বিপরীত দিকে জোয়ার এবং সূর্যের দিকের পৃথিবীর অংশে ও এর বিপরীত দিকে ভাঁটা হয়। এর ফলে চাঁদের দিকের পৃথিবীর অংশে ও তার বিপরীত দিকে পানি তত বেশি ফুলে উঠতে পারে না। এর ফলে সপ্তমী ও অষ্টমী তিথির ঐ দুই দিন জোয়ার সবচেয়ে কম হয়ে থাকে। এ কারণে অমাবস্যার ও পূর্ণিমার পরে সপ্তমী ও অষ্টমী তিথির জোয়ারকে মরা জোয়ার বলা হয়। এরূপ জোয়রকে মরা কটালও বলা হয়। [মো: শাহীন আলম]


সহায়িকা: রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, (২০১৭-২০১৮), প্রাকৃতিক ভূগোল, কবির পাবলিকেশন, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৫৫২-৫৫৩।


Animation Source: moon.nasa.gov


Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *