প্রস্তর যুগ: প্রাচীন-মধ্য-নব্য প্রস্তর যুগ

বিশ্ব ইতিহাসে প্রস্তর যুগ [Stone Age] হল পৃথিবীতে মানুষ ও তার সমাজের বিবর্তন ধারার গুরুত্বপূর্ণ একটি কালপর্ব। প্রস্তরযুগে প্রস্তর (পাথর) ছিল মানুষের হাতিয়ার (tools) তৈরির মূল উপকরণ। তবে প্রস্তর যুগে পাথরের ব্যবহারের পাশাপাশি মানুষ কর্তৃক কাঠ এবং প্রাণীর হাড়ের তৈরি হাতিয়ার ব্যবহারের নমুনা পাওয়া যায়। আরও জানা যায়, এ যুগে স্বর্ণের ব্যবহারও হয়েছিল, এবং এর প্রমাণও পাওয়া যায়। তবে অন্য কোন ধাতুর ব্যবহার সম্পর্কে কোন তথ্য জানা যায়নি। প্রস্তর যুগ থেকে প্রযুক্তির উন্নতি সাধন শুরু হয় বলে মনে করা হয়।

ধারণা করা হয় যে, পূর্ব আফ্রিকার সাভানা অঞ্চল থেকে পৃথিবী অন্য সব অঞ্চলে মানুষের ছড়িয়ে পড়ার সময় (এখন থেকে প্রায় ৯ লক্ষ বছর আগে) থেকে প্রস্তর যুগের সূত্রপাত হয়েছিল। কৃষির উদ্ভাবন, পশু গৃহপালিতকরণ এবং তামার ব্যবহারের শুরুর মাধ্যমে প্রস্তর যুগের সমাপ্তি ঘটে। আর নৃবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ এবং প্রত্নতত্ত্ববিদদের অনেকেই প্রস্তর যুগকেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ বলে থাকেন। এর মূল কারণ হল প্রস্তর যুগ পর্যন্ত মানুষ লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারেনি। নৃবিজ্ঞানীগণ প্রস্তর যুগকে ৩টি পর্যায়ে ভাগ করেন। এগুলো হল –

(১) প্রাচীন প্রস্তর যুগ (paleolithic age),

(২) মধ্য প্রস্তর যুগ (mesolithic), ও

(৩) নব্য প্রস্তর যুগ (neolithic age)।

(১) প্রাচীন প্রস্তর যুগ [Paleolithic Age]: গ্রিক Paleos এবং Lithic এ দু’টি শব্দের সমন্বয়ে Paleolithic শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। Paleos এর অর্থ হল প্রাচীন বা প্রত্ন বা পুরা বা আদি এবং Lithic এর অর্থ হল প্রস্তর বা পাথর। সুতরাং Paleolithic Age  এর মানে হল প্রাচীন প্রস্তর যুগ বা প্রত্নপ্রস্তর যুগ বা পুরা প্রস্তর যুগ বা আদি প্রস্তর যুগ বা প্যালিওলিথিক যুগ। প্রস্তরযুগের (stone age) প্রথম পর্যায় হল প্রাচীন প্রস্তর যুগ। প্রাচীন প্রস্তর যুগ বলতে সে সময়কে বুঝায় যে সময়ে আদিম মানুষ কেবলই প্রাথমিক পাথরের যন্ত্রপাতি (stone tools) বানাতে শুরু করেছিল। শিকার করা ও খাবার সংগ্রহ করা ছিল এ যুগের মানুষের মূল পেশা। এদের জীবনযাত্রা ছিল যাযাবরের মত। এ সময়কার মানুষের উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার ছিল কুঠার, বর্শা, ধারালো পাথর, হারপুন প্রভৃতি।

প্রস্তরযুগ: পেলিওলিথিক গুহাচিত্র
উত্তর স্পেনের প্যালিওলিথিক (paleolithic) গুহাচিত্র।

নৃবিজ্ঞানীগণ, এখন থেকে প্রায় ৯ লক্ষ বছর পূর্বের সময়কে প্রাচীন প্রস্তর যুগের সন্ধিকাল মনে করেন।  আবার, নৃবিজ্ঞানীগণ প্রাচীন প্রস্তর যুগকে ৩টি পর্যায়ে ভাগ করেন। এগুলো হল –

(১.ক) নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুগ;

(১.খ) মধ্য প্রাচীন প্রস্তর যুগ; ও

(১.গ) উচ্চতর প্রাচীন প্রস্তর যুগ।

(১.ক) নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুগ [Lower Paleolithic Age]: প্রাচীন প্রস্তর যুগের সূচনা পর্যায় হল নিম্ন প্রাচীন প্রস্তরযুগ। নিম্ন প্রাচীন প্রস্তরযুগকে গুনজ (gunz) হিমযুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। প্রাচীন প্রস্তরযুগের এ সময়টি গুনজ (gunz) হিমযুগ (প্রথম হিমযুগ) থেকে রিস (riss) হিমযুগ (দ্বিতীয় হিমযুগ) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখানে, গুনজ (gunz) হিমযুগ এখন থেকে প্রায় ৯ লক্ষ বছর আগের এবং রিস (riss) হিমযুগ এখন থেকে প্রায় ৮০ হাজার বছর আগের সময়কে নির্দেশ করে। নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুগের স্থিতিকাল সর্বাপেক্ষা বেশি ছিল। আরও ধারণা করা হয় যে, নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের চিন্তা-চেতনা ও কৃৎকৌশলের পরিবর্তন এসেছে খুবই ধীরে। নৃবিজ্ঞানীগণ মনে করেন, পিথিক্যানথ্রোপাস (pithecanthropus) এবং হোমো ইরেক্টাস (homo erectus) হল নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ।

(১.খ) মধ্য প্রাচীন প্রস্তর যুগ [Middle Paleolithic Age]: প্রাচীন প্রস্তর যুগের মধ্য পর্যায় হল মধ্য প্রাচীন প্রস্তরযুগ। মধ্য প্রাচীন প্রস্তরযুগের এ সময়টিকে রিস (riss) হিমযুগ (তৃতীয় হিমযুগ) থেকে ঊম (wurm) হিমযুগের (চতুর্থ হিম যুগ) মধ্যবর্তী উষ্ণ যুগকে নির্দেশ করে। এখানে, রিস (riss) হিমযুগ এখন থেকে প্রায় ৮০ হাজার বছর আগের এবং ঊম (wurm) হিমযুগ এখন থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর আগের সময়কে নির্দেশ করে। নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, মধ্য প্রাচীন প্রস্তরযুগে ঋজু মানবের (homo erectus) আবির্ভাব ঘটেছিল। 

(১.গ) উচ্চতর প্রাচীন প্রস্তর যুগ [Upper Paleolithic Age]: প্রাচীন প্রস্তর যুগের শেষ পর্যায় হল উচ্চতর প্রাচীন প্রস্তরযুগ। উচ্চতর প্রাচীন প্রস্তরযুগের এ সময়টিকে ঊম (wurm) হিমযুগের (চতুর্থ হিম যুগ) সময়কে নির্দেশ করে। ঊম (wurm) হিমযুগ বলতে এখন থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর আগের সময়কে নির্দেশ করা হয়। নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, উচ্চতর প্রাচীন প্রস্তরযুগের স্থায়িত্বকাল তুলনামূলক কম ছিল। এ যুগে জলবায়ু শীতল ছিল, আর কারণে মানুষ অধিকাংশ সময়ে গুহায় বসবাস করে বলে অনুমান করা হয়। ঊম হিমযুগের শেষে পৃথিবী আগের চেয়ে উষ্ণতর এবং আর্দ্র হয়ে উঠে। এ সময়ে মানুষ পশু শিকার পেশা থেকে মৎস্য শিকার পেশার প্রতি ক্রমশ আগ্রহী হয়ে উঠে।

(২) মধ্য প্রস্তর যুগ [Mesolithic]: প্রাচীন প্রস্তর যুগ এবং নব্য প্রস্তর যুগ-এর মধ্যবর্তী একটি যুগ হল মধ্য প্রস্তর যুগ বা মেসোলিথিক যুগ। মধ্য প্রস্তর যুগের স্থিতিকাল নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে লেভান্তে ২০,০০০ থেকে ৯,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কৃষিজ উপকরণসমূহ মধ্য প্রস্তর যুগীয়। জানা যায় যে, ইউরোশিয়াতে মধ্য প্রস্তর যুগের কালক্রমের ভিন্নতা রয়েছে। প্লাইস্টোসিন যুগের পরবর্তী এবং কৃষিকাজের উপকরণ আবিষ্কারের পূর্বের যুগকে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে মধ্য প্রস্তর যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এ সময়ের স্থিতিকাল ১০,০০০ থেকে ৫,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ছিল। পশ্চিম ইউরোপের আজেলীয় সংস্কৃতি, জাপানের জোমন সংস্কৃতি, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার জার্জিয় সংস্কৃতি, প্রভৃতি মধ্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি।

মেসোলিথিক মাইক্রোলিথ
মেসোলিথিক মাইক্রোলিথ (mesolithic microliths)।

(৩) নব্য প্রস্তর যুগ (Neolithic age): মধ্য প্রস্তর যুগের পরবর্তী পর্যায় হল নব্য প্রস্তরযুগ। নৃবিজ্ঞানীগণের মতানুসারে, প্রস্তর যুগের সমাপ্তি পর্যায় হল নব্য প্রস্তর যুগ বা নিউলিথিক যুগ। নব্য প্রস্তর যুগের স্থিতিকাল নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। ASPRO Chronology অনুসারে, ১০,২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অঞ্চলে নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা হয় এবং পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এ যুগের সূচনা হয়। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, আনুমানিক ৪,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে নব্য প্রস্তর যুগের সমাপ্তি হয়।

 নিওলিথিক শিল্পকর্ম
ব্রেসলেট, কুড়ালের মাথা, চিসেল এবং পালিশ করার সরঞ্জামসহ নব্য প্রস্তর যুগের (neolithic) শিল্পকর্ম।

নৃবিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে, এ যুগে মানুষের আচরণ এবং সংস্কৃতিতে প্রগতি এবং পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যেমন – নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ কর্তৃক বন্য পশুকে গৃহপালিত পশুতে রূপান্তর করা হয় এবং বন্য ও গৃহজাত শস্যের ব্যবহার করা হয়। নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ পাথরের হাতিয়া ও ব্যবহার্য জিনিসপত্রের উন্নতি সাধন করেছিল। নৃবিজ্ঞানীগণ ধারণা করেন, কঠিন ধাতুর ব্যবহার শুরু করার মাধ্যমে নব্য প্রস্তর যুগের সমাপ্তি হয়েছিল। নব্য প্রস্তর যুগের শেষ ভাগে মানুষ ধাতুর ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারে। এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে তাম্র যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, এবং লৌহ যুগের সূচনা হয়। [মো: শাহীন আলম]


সহায়িকা:
১। বাকী, আবদুল, সাংস্কৃতিক ভূগোল ২০২২-২০২৩, স্বজন প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৯৯ – ১১৪।
২। বাকী, আবদুল, ভুবনকোষ, ২০১৩, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা।
৩। Stone Age


Image Source: wikimedia.org


Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *